Friday, September 19, 2014

ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় পাঁচ জালিয়াতচক্র সক্রিয়:কালের কন্ঠ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় হাজার ৫৮২টি আসনের বিপরীতে এ বছর ভর্তির জন্য আবেদন করেছে তিন লাখ এক হাজার ১৩৮ জন শিক্ষার্থী। প্রতি আসনের বিপরীতে প্রার্থী প্রায় ৪৬ জন। তাই খুব ভালো প্রস্তুতি সত্ত্বেও তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে শেষ পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থীই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না। তবে সবার বেলায় এ কথা খাটে না। অনেকে পরীক্ষার দিন সকালে ফুরফুরে মেজাজে হলে যায়। পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা বাজলে তাদের মোবাইল ফ
োনে চলে আসে সব উত্তর। তা দেখে উত্তরপত্র ভরাট করলেই মেধাতালিকায় জায়গা পাওয়া নিশ্চিত। এ জন্য তাদের খরচ করতে হয় তিন লাখ টাকা। টাকাটা নেয় জালিয়াতচক্র। এ রকম পাঁচটি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে। ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সক্রিয় তারা। চক্রের সদস্যসংখ্যা ২০০। পরীক্ষার মৌসুমে ভর্তির ‘নিশ্চয়তা’ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। পুরো কার্যক্রম চলে মোবাইল ফোন ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এ পরিস্থিতির মধ্যেই আজ শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চক্রের সঙ্গে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পরীক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক ও কর্মচারীরা জড়িত। প্রত্যেকের দায়িত্ব ভাগ করা। প্রথমে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে। পরীক্ষা হলের কর্মচারীরা চুক্তিবদ্ধ শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট স্থানে সিট ফেলার ব্যবস্থা করেন। পরীক্ষা শুরুর পরপরই প্রশ্ন বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন পরীক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক-কর্মচারীরা। প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এদের অনেকে আবার বিভিন্ন কোচিং সেন্টারেও পড়ায়। উত্তরগুলো তারা সরবরাহ করে আরেক পক্ষের কাছে। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলো পরীক্ষার্থীর মোবাইল ফোনে পৌঁছে দেয়। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কেন্দ্রগুলোতে জালিয়াতচক্র সক্রিয় থাকে। প্রক্রিয়ায় জড়িতরা সবাই টাকার ভাগ পায়। বড় অংশ যায় চক্রের হোতাদের কাছে। প্রশ্নপত্র কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার জন্য শিক্ষক-কর্মকর্তারা পান ২০-২৫ হাজার টাকা, সমাধানকারী শিক্ষার্থীরা পায় ৫-১০ হাজার টাকা। কোনো কেন্দ্রেই মেটাল ডিটেক্টর না থাকায় গোপনে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকলেও ধরা পড়ে না অনেকে। জালিয়াতি বন্ধে এ বছর ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে তাতেও জালিয়াতি থামছে না। জালিয়াতির সময় আটকও হচ্ছে অনেকে। মামলাও হচ্ছে। তবে পরে জামিনে বেরিয়ে যায় সবাই। এ বছর ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ও ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সময় ২৪ জনকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ২০ জন ভর্তি পরীক্ষার্থী। বাকিরাও চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিল। আটক প্রতি পরীক্ষার্থীর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল তিন-চার লাখ টাকার। এ বিষয়ে কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ‘যারা ধরা পড়ছে, তারা তো পড়ছেই। এর বাইরেও হয়তো কিছুটা পার পেয়ে যাচ্ছে। তবে এ সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’ চক্রের এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে কালের কণ্ঠকে জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিষয়ের শিক্ষার্থীরা জালিয়াতি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। মেধাবী এসব শিক্ষার্থী অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের সমাধান করতে সক্ষম। প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্ন সমাধানের জন্য দুজন করে শিক্ষার্থী থাকে। পাঁচটি চক্রে এ রকম শ খানেক শিক্ষার্থী জড়িত। ভর্তি পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরীক্ষার কক্ষ থেকে প্রশ্নপত্র শিক্ষক-কর্মকর্তার হাত হয়ে চলে আসে জালিয়াতচক্রের কাছে। কোনো কেন্দ্রের কর্মকর্তা প্রশ্নটি স্ক্যান করে পাঠান। অনেকে মোবাইল ফোনে ছবি তুলে পাঠায়। সমাধানের জন্য তা পাঠানো হয় সেই শিক্ষার্থীদের কাছে। তারা সমাধান শেষে পাশেই বসে থাকা খুদে বার্তা প্রেরণকারী দলের কাছে উত্তর সরবরাহ করে। তারা কম্পিউটার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে মুহূর্তেই চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদর কাছে তা পাঠিয়ে দেয়। পরীক্ষার্থীর কাছে থাকে আরেকটি ডিভাইস। উত্তর পাওয়ার পর তা দেখে দেখে প্রশ্নের সমাধান করে তারা। জড়িত পাঁচ চক্র : পাঁচ চক্রের মধ্যে একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলকেন্দ্রিক। গণিত বিভাগের এক শিক্ষার্থী এ চক্রের হোতা। গত শুক্রবার ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগে তাকে আটক করা হয়েছে। আরেকটি চক্র রয়েছে মুহসীন হলকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের এক নেতা। হলের এক নেতাও আছেন তাঁর সঙ্গে। তাঁদের একজনের বিরুদ্ধে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণেরও অভিযোগ রয়েছে। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ছাত্রলীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাকে দিয়ে সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করিয়েছেন। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান জনির বিরুদ্ধেও জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনিও একটি চক্রের নেতৃত্ব দেন। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় নয়, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাংক, প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গত শুক্রবার ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার জালিয়াতির সময় মতিঝিল আইডিয়াল কলেজ থেকে জনির খালাতো ভাই সৈয়দ আলমগীর কবিরকে আটক করা হয়। আলমগীর কবিরকে ছাড়িয়ে নিতে আসেন জনি। আলমগীরও জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর জনির জালিয়াতিতে জড়িত থাকার কথা জানান। টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সবুজও একটি চক্রের নেতৃত্ব দেন। গত শুক্রবার ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সময় ইমদাদুল হক খোকন নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। পেশায় তিনি ব্যাংক কর্মকর্তা। তাঁকে সব ধরনের সাহায্য করেন সবুজ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী খোকন নামের একজনের নেতৃত্বেও গড়ে উঠেছে আরেকটি চক্র। তিনিও একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের ১৬ তলার একটি কক্ষ থাকেন তিনি। রাজন ও মিলন নামের দুজন জালিয়াতিতে তাঁকে সহায়তা করেন। মিলন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস থেকেও জালিয়াতচক্রের কয়েকজন সদস্যের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র জাকির হোসেন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এনামুল হক, বাংলা বিভাগের রায়হান ও মার্কেটিং বিভাগের এমদাদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এখলাস, আনসার ভিডিপি ব্যাংকের এজিএম ড. শাহজাহান, ট্রাস্ট ব্যাংকের সাজ্জাদ হোসেন, অগ্রণী ব্যাংকের আলম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এম আমজাদ আলী বলেন, আনুমানিক পাঁচটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। এর মধ্যে কয়েকটি চিহ্নিত করা গেছে। কয়েকটিকে টার্গেট করে এগুচ্ছি। আশা করি সবগুলো সিন্ডিকেট ধরা সম্ভব হবে। জালিয়াতি বন্ধে তৎপর রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আবার যারা এ বিষয়টি উদ্ঘাটন করতে কাজ করছেন, তাঁদেরও সাহায্য করছি।

No comments:

Post a Comment