Monday, September 22, 2014

ঘাঁটিতেই অস্তিত্ব সঙ্কটে জাতীয় পার্টি:নয়াদিগন্ত

আবারো রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটি বিলুপ্ত করার জেরে দুই পক্ষের প্রকাশ্য বিভক্তি, মিছিল-মিটিং ও সংঘর্ষের কারণে দুর্গ বলে পরিচিত রংপুরে মহা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে জাতীয় পার্টি। শুধু তা-ই নয়, রংপুরেই মহাচ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এরশাদের পাহাড় প্রমাণ জনপ্রিয়তা। ১০ দিন ধরে চলা দুই পক্ষের কর্মসূচিতে জনসমাগমের হার ও মতামত বিশ্লেষণ করেই এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকেরা। এতে দলটির জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে ব
লেও মনে করেন তারা। এ নিয়ে শঙ্কিত এরশাদভক্তরা।  ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতার দৃশ্যপটে চলে আসেন ভারতের কুচবিহারে জন্মগ্রহণকারী রংপুরে লালিত-পালিত তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরপর ৯ বছর চলে তার একচ্ছত্র শাসন। ক্ষমতায় থেকে জাতীয় পার্টি গঠন করলেও সে সময় রংপুরে দলটির অবস্থান ছিল কিং পার্টির মতো। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হলে তিনি কারাবন্দী হন। এরপরই মূলত শুরু হয় জাতীয় পার্টির উত্থান এবং সেটার আঁতুরঘর হয় রংপুর। সে সময় সাবেক এমপি দৈনিক দাবানল সম্পাদক খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল, বর্তমান সিটি মেয়র সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু, আবদুল লতিব খানের নেতৃত্বে রংপুরে গড়ে ওঠে এরশাদ মুক্তির তীব্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনের কারণেই রংপুর হয়ে ওঠে জাতীয় পার্টির দুর্গ। এরশাদকে জেলে রেখে ১৯৯১ সালে রংপুর থেকে পাঁচটি আসনে বিজয়ী করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন রংপুরের মানুষ। পরে জেল থেকে বেরিয়ে ঋণ পরিশোধের নামে আবেগতাড়িত বক্তব্য দিয়ে এরশাদ হয়ে উঠেন রংপুর অঞ্চলের মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। সে সময় প্রবাদ হয়ে যায়, এরশাদ যদি কলাগাছকেও নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেন তাহলে কলাগাছও এমপি হয়ে যাবে। প্রবাদ বাক্যটিও বাস্তবে রূপ নেয়। ১৯৯৬ সালেও পাঁচটি আসনে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে এরশাদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে যায়। আর প্রবাদ বাক্য বাস্তবে রূপ নেয় তার ছেড়ে দেয়া পীরগঞ্জ আসনে মুন্সীগঞ্জের মোয়াজ্জেম হোসেন আর মিঠাপুকুর থেকে চাঁদপুরের মিজানুর রহমান চৌধুরীর এমপি হওয়ার মাধ্যমে। ২০০১ সালেও পাঁচটি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন এরশাদ। এই সময়ের মধ্যে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলেও শক্ত ভিত গড়ে জাতীয় পার্টি।  বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরই মধ্যে এরশাদের নানাবিধ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, জেলভীতি এবং ২০০৬ সালে জোট বাঁধা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বেই তার জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারের পারদ কমতে থাকে। আর আওয়ামী লীগের সাথে জোট বাঁধার পর থেকেই শুরু হয় জনপ্রিয়তার ধস ও আসন কমার ইতিহাস। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খোদ রংপুর থেকেই হাতছাড়া হয়ে যায় তিনটি আসন। শুধু তা-ই নয়, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এরশাদের পরপর পাঁচটি সিদ্ধান্তের কারণে হাতছাড়া হয়ে যায় সিটি মেয়রের পদটি। এ সময় তৃণমূল জাতীয় পার্টি গঠনেরও ঘটনা ঘটে। রংপুরের মানুষ এরশাদের ওপর নাখোশ হয়ে পড়েন। শুরু হয় দলে প্রকাশ্য বিভক্তি ও বিরোধিতা। এরপর নানা সময়ে ‘সকালে এক কথা বিকেলে আরেক কথা এবং রাতে আরেক কথা’ বলে রাজনীতির মাঠে এবং রংপুরের মানুষের কাছে হাস্যরসের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হন এক সময়ের এই ‘সেনানায়ক’। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা এবং জাতীয় পার্টির রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটি পুনর্গঠন করার মাধ্যমে রংপুরে আবারো এরশাদের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। কিন্তু নানা নাটকীয়তায় সে সময় আগের কমিটি বহাল এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে রংপুরের মানুষের হৃদয় থেকে বের হয়ে যান এরশাদ। তার প্রমাণও মেলে ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন এই নির্বাচনে। রংপুর-৩ সদর আসনে এরশাদ মাত্র ৫৫ হাজার ৪৫৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাসদের যুবনেতা শেখ সাব্বির আহম্মেদ মশাল প্রতীক নিয়ে ২৫ হাজার ৮৮৬ ভোট পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এখানে ভোটার ছিলেন চার লাখ ৫০ হাজার ৬২০ জন। তাদের তিন ভাগেরও কম লোক ভোট দিতে গিয়েছিলেন। ওই ভোটে এরশাদের পক্ষে বিভিন্ন কেন্দ্রে জালভোট দেয়ারও অভিযোগ ছিল। আর লালমনিরহাট-১ পাট গ্রাম আসন থেকে পাঁচ হাজার ভোট পেয়ে পরাজিত হন। এই নির্বাচনে রংপুরের চারটি আসন হাতছাড়া হয়ে যায় এরশাদের।  ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচ দফার উপজেলা নির্বাচনেও রংপুরের আটটি উপজেলায় এরশাদকে ভোটের মাধ্যমে ‘না’ বলে দেন রংপুরের মানুষ। শোচনীয় পরাজয় হয় এরশাদ সমর্থিত প্রার্থীদের। ভোটের পরিসংখ্যানেও তার প্রমাণ মেলে।  অন্য দিকে চলতি মাসের ১০ তারিখে আবারো পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গাকে অব্যাহতি এবং রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটি বিল্প্তু করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর আবারো নতুন করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এরশাদ। রংপুরে জাতীয় পার্টি বিভক্ত হয়ে রূপান্তরিত হয় এরশাদপন্থী ও রাঙ্গাপন্থীতে। নতুন আহ্বায়ক কমিটির নেতারা এরশাদের পৈতৃক নিবাস স্কাই ভিউ লাঙ্গল ভবনে এরশাদের সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতার সাথে গণসংযোগ চালিয়ে যেতে থাকেন। অন্য দিকে রাঙ্গাপন্থীরা প্রকাশ্যে রাঙ্গার পদ-পদবি পুনর্বহালের দাবিতে পার্টি অফিস দখলে নিয়ে মিছিল মিটিং ও সমাবেশ করতে থাকেন। এরশাদের এ ধরনের সিদ্ধান্তে পার্টির উভয় পক্ষের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী নাখোশ হয়ে পর্দার আড়ালে চলে যান।  গত শনিবার এরশাদকে অভিনন্দন জানিয়ে এরশাদপন্থীরা পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেই কর্মসূচি বানচাল করতে রাঙ্গার পদ-পদবি ফেরানোর দাবিতে তারাও একই স্থানে একই সময়ে পাল্টা বিক্ষোভ ও সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা চালায়। এ নিয়ে উভয়পক্ষই পরস্পরকে দোষী দাবি করে এরশাদপন্থীরা শুক্রবার লাঙ্গল ভবনে এবং রাঙ্গাপন্থীরা জাতীয় পার্টি অফিসে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে। প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় পাবলিক লাইব্রেরি মাঠ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। পরে এরশাদপন্থীরা লাঙ্গল ভবন থেকে নগরীর এরশাদমুক্তি আন্দোলনের সূতিকাগার শাপলা চত্বরে মিছিল নিয়ে সমাবেশ করার সময় ককটেল হামলার শিকার হন। অন্য দিকে রাঙ্গাপন্থীরাও পার্টি অফিস থেকে মিছিল নিয়ে পায়রাচত্বরে দাবি আদায়ে সমাবেশ করে। রংপুরে যখন এরশাদপন্থীদের সমাবেশে ককটেল হামলা ও তাদের রুখে দেয়ার দাবিতে পায়রা চত্বরে রাঙ্গাপন্থীদের সমাবেশ চলছিল ঠিক সেই সময়েই ঢাকায় ছিল উল্টো পরিস্থিতি। এরশাদের চীন সফরে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে এরশাদকে উষ্ণ অভিনন্দন জানানোর চিত্র শনিবার টিভি পর্দায় এবং রোববার বিভিন্ন সংবাদপত্রে দেখে মানুষ হতবাক হয়ে যান। গুজব ছড়িয়ে যায় হয়তো আবারো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছেন এরশাদ। উভয়পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে টানাপড়েন।  এরশাদ অনুমোদিত রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব সাবেক এমপি এইচ এম শাহরিয়ার আসিফ নয়া দিগন্তকে জানান, এর আগে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সময়ে সময়ে ক্ষমতাসীনদের চাপসহ বিভিন্ন কারণে এরশাদ সাহেব তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন। এখন আর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সুযোগ নেই। রংপুরের মানুষ গোস্যা হলেও বড় আব্বার সাথে আছেন ও থাকবেন। পাশাপাশি রংপুরের মানুষ রাঙ্গার ২৪ বছরের আধিপত্যের অবসান চান।  অন্য দিকে মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা নয়া দিগন্তকে বলেন, রাঙ্গার সাথে সমন্বয় করে রংপুরে আমরা রাজনীতি করব না। কারণ নেতাকর্মীরা রাঙ্গাকে চায় না। তিনি আরো বলেন, এরশাদের জনপ্রিয়তা আগের মতোই আছে। তবে নেতৃত্বের বিভাজনের কারণে রংপুরে জাতীয় পার্টি স্তিমিত ছিল। আবারো তারা জেগে উঠেছে। এই জোয়ারকে কেউ যদি বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তবে রংপুরের মানুষের জানা আছে তা কিভাবে মোকাবেলা করতে হয়। তিনি বলেন, শনিবার মাঠে রাঙ্গার লোক কত ছিল এবং আমাদের লোক কত ছিল তা মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এরশাদ স্যার যদি রংপুরের কমিটির ব্যাপারে আবারো সিদ্ধান্ত বদলান, তাহলে আর কখনো রংপুরের মানুষকে স্যারের পাশে পাওয়া যাবে না। কারণ ইতোমধ্যেই নানা কারণে মানুষ খুব কষ্ট পেয়েছেন।  এ দিকে বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সামসুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গার প্রেসিডিয়াম ও জেলা এবং মহানগর কমিটির পদ পুনর্বহালের দাবিতে আমরা মাঠে আছি। আশা করি শিগগিরই আমাদের দাবি আদায় হয়ে যাবে।  জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সহসভাপতি ও এরশাদ মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি আব্দুল লতিব খান জানান, রাঙ্গা ছাড়া রংপুরে জাতীয় পার্টির কোনো নেতা নেই। রাঙ্গাই পারে রংপুরে জাতীয় পার্টিকে রক্ষা করতে। তিনি এখন মন্ত্রী হয়েছেন উন্নয়ন করছেন। বহিষ্কৃতরা দুঃসময়ে মাঠে ছিল না। এ দিকে বিভক্ত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা যাই বলুন না কেন, বিশ্লেষকেরা বলছেন ভিন্ন কথা।  রাজনীতি বিশ্লেষক রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, জাতীয় পার্টি এখন রংপুরে এরশাদ ও রাঙ্গাপন্থীতে রূপান্তরিত হয়েছে। শনিবারের এরশাদপন্থীদের সমাবেশে লোকজন বেশি উপস্থিত থাকলেও কোনো পক্ষেই উপস্থিতি এরশাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণের মতো যথেষ্ট ছিল না। আসলে এরশাদ মিথ্যার আশ্রয় ও প্রতারণা করে রংপুরের মানুষকে পুঁজি বানিয়ে তাদের আবেগ অনুভূতি ভালোবাসাকে ব্ল্যাকমেইলিং করে নিজেকে রাজনীতির মাঠে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আর পারিবারিকভাবে ক্ষমতা ও অর্থের মালিক হয়েছেন। রংপুরের মানুষ সেটি বুঝতে পেরেই তাকে যেভাবে তুলেছিলেন সেভাবেই ফেলে দিয়েছেন।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক প্রফেসর সামসুল আলম সরকার জানান, এরশাদের স্বরূপ এখন রংপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে উন্মোচিত। সে কারণেই এরশাদকে রংপুর অঞ্চল থেকে গুডবাই জানিয়ে দিয়েছেন মানুষ। তিনি বলেন, ‘এরশাদের মিথ্যা ও প্রতারণামূলক পানি পড়ায়’ আর বিশ্বাস নেই রংপুর অঞ্চলের মানুষের।

No comments:

Post a Comment