Saturday, September 27, 2014

বরিশাল সদর হাসপাতালের বেহাল দশা:নয়াদিগন্ত

বেহাল অবস্থার মধ্য দিয়েই চলছে বরিশাল সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা। চিকিৎসক, কর্মচারী ও যন্ত্রপাতি সঙ্কটের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে চিকিৎসাসেবা। ১০০ শয্যার এই হাসপাতালটির বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ ও আন্তঃবিভাগে প্রতিদিন ১০০’র বেশি রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। তবে চিকিৎসক, কর্মচারী ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এ বিষয়ে নগরীর ভাটিখানা এলাক
ার বাসিন্দা পারভীন বেগম জানান, সকাল ১০টায় বহির্বিভাগে এসেছি সন্তানকে ডাক্তার দেখাবো বলে। রোগীদের ভিড় ও মাত্র একজন চিকিৎসক থাকায় ২ ঘণ্টা পর ডাক্তারের কাছে যেতে পেরেছি। সেই সাথে তীব্র গরমে নিজেকেই অসুস্থ মনে করছেন বলে জানান তিনি। এই হাসপাতালে প্যাথলজি বিভাগে কিছু পরীা-নিরীা ও ম্যানুয়াল এক্স-রে ছাড়া উন্নত চিকিৎসায় সহায়ক কোনো যন্ত্রপাতি নেই। হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, কিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট পোস্টগুলোতে মাত্র একজন করে কর্মী থাকায় যে দিন কেউ ছুটিতে থাকেন সে দিন সেই বিভাগে পরীা-নিরীা বন্ধ থাকে। এ ছাড়া হাসপাতালের একমাত্র আলট্রাসাউন্ড মেশিনটিও দীর্ঘদিন ধরে বিকল। ইসিজির জন্য একটি মেশিন থাকলেও তা পরিচালনার জন্য নেই কোনো টেকনোলজিস্ট। ডিজিটাল এক্স-রে করার কোনো ব্যবস্থা তো নেই-ই বরং ম্যানুয়াল বা সনাতন পদ্ধতির যে তিনটি এক্স-রে মেশিন আছে তার দু’টিই নষ্ট। আর সচল মেশিনটি ভবনের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার কারণে বৃষ্টিতে বন্ধ রাখা হয়। ফলে রোগীদের পড়তে হয় সীমাহীন দুর্ভোগে। অর্থোপেডিক বিভাগে চিকিৎসা নিতে আশা নগরীর পলাশপুরের বাসিন্দা অনিক (১৫) জানায়, তার ডান পায়ে ব্যথার কারণে হাঁটতে পারছে না। সকাল ৯টায় হাসপাতালে এসে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে দেখাতে পারলেও ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনের অভাবে তাকে সদর রোডের একটি বেসরকারি সেন্টারে যেতে হয়। তবে সড়কে যানজট থাকায় যাওয়া-আসার পথে তাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে  হয়। ডেন্টাল বিভাগে জনবল থাকলেও সেখানে নেই কোনো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। নামে জেনারেল হাসপাতাল হলেও এখানে নেই অপারেশনের ন্যূনতম সরঞ্জাম। একটি মাত্র ওটি টেবিল তাও ভাঙা। আর ওটি টেবিলের ওপর থাকা লাইটেরও একই অবস্থা। ফলে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে অস্ত্রোপচারের কাজ। বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বা জেনারেটর না থাকায় ও হাসপাতালের একমাত্র পানি ফোটানোর মেশিনটি প্রায়ই বিকল থাকে এবং অস্ত্রোপচার ও এর সরঞ্জাম বিশুদ্ধকরণের কাজ ব্যাহত হয়। সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে সংক্রামক রোগের ঝুঁকি। যান্ত্রিক এসব ত্রুটির কথা স্বীকার করে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার জানান, যন্ত্রপাতি চেয়েও না পাওয়ায় অনেক কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো রোগীকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নয়তো বাহির থেকে পরীা-নিরীা করিয়ে এনে ব্যবস্থাপত্র দিতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন পটুয়াখালীর বাউফলের আব্দুল হালিম খান (৫৪) জানান, তিনি নানাবিধ শারীরিক সমস্যার কারণে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তির পর চিকিৎসক নানা পরীা-নিরীা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো পরীাই হাসপাতালে করতে পারেননি তিনি। সব পরীাই বাইরের প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করতে হয়েছে। অথচ এটা সরকারি হাসপাতাল। হাসপাতালের বহির্বিভাগে সার্জারি, গাইনি, মেডিসিন, ডায়রিয়া, চর্ম ও যৌন, চু ও শিশু বিভাগসহ ১০টি বিভাগে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে নিয়মিত। তবে নাক-কান-গলা বিভাগে চিকিৎসক না থাকায় এ বিভাগের সেবা বন্ধ রয়েছে। ডেন্টাল বিভাগের যন্ত্রপাতি না থাকায় রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেয়া ছাড়া আর কোনো সেবা দেয়া হচ্ছে না বলে জানান ভারপ্রাপ্ত ওই মেডিক্যাল অফিসার। বরিশাল সদর হাসপাতালে চিকিৎসকদের মঞ্জুরিকৃত ৩২টি পদের বিপরীতে শূন্য পদ রয়েছে ১৩টি। হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্র জানায়, গাইনি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট একটি, মেডিসিন বিভাগে সিনিয়র কনসালট্যান্ট একটি এবং আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের একটি মাত্র পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। তবে ভারপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডা: দেলোয়ার হোসেন। এ ছাড়া ইএমও চারটি পদের একটি, আইএমও দু’টি পদের মধ্যে দু’টিই, মেডিসিনের সহকারী রেজিস্ট্রার দু’টি পদের মধ্যে দু’টি, সার্জারির সহকারী রেজিস্ট্রার দু’টি পদের মধ্যে দু’টিসহ ১৩টি পদ শূন্য থাকায় ১৯ জন চিকিৎসক এ হাসপাতালে সেবাকার্যক্রম পরিচালনা করছেন। চিকিৎসকের পাশাপাশি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সঙ্কটও চরম আকার ধারণ করেছে। প্রশাসনিক বিভাগ জানায়, এ হাসপাতালে একজন মাত্র ওয়ার্ড মাস্টার দায়িত্ব পালন করছেন। অ্যাম্বুলেন্স চালক আছেন দু’জন। স্ট্রেচার বেয়ারার দু’টি পদের দু’টিই শূন্য। বাবুর্চির ছয়টি পদ থাকলেও আছেন দুইজন। এমএলএসএসের পদ আছে ২০টি। কিন্তু কর্মী আছেন মাত্র সাতজন। ঝাড়–দারের ১২ পদের মধ্যে আছেন চারজন। আর সরদারের পদ তো একেবারেই খালি। তবে সেবিকাদের কোনো সঙ্কট নেই জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার জানান, চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট, কর্মচারীসহ সব শূন্যপদ পূরণের জন্য বারবার লিখিত দেয়া হচ্ছে কর্তৃপকে। তবে অজানা কারণে সে পদগুলো পূরণ হচ্ছে না। আর জনবল সঙ্কটের হাসপাতালে কর্মরত কেউ কোনো কারণে ছুটিতে গেলে রোগীদের পড়তে হয় বিপাকে। হাসপাতালটি নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোড সংলগ্ন হওয়ায় এখানে রোগীর চাপও বেশি বলে দাবি করেন এই চিকিৎসক। বরিশাল সদর হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে ১০০ শয্যার অনুকূলে সার্জারি, গাইনি, মেডিসিন ও ডায়েরিয়া রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে এখানে মূলত ডায়েরিয়া ও গাইনি রোগীর প্রাধান্য বেশি। এ হাসপাতালে ১২ বছরের ঊর্ধ্বে ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। বেডের তুলনায় রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায় প্রায়ই হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় রেখেই রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। ১৯১২ সালের ১৩ জুলাই চালু হওয়া বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল পুরনো দু’টি ভবনের ছাদের পলেস্তরা প্রতিনিয়ত খসে পড়ছে। বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হচ্ছে এক্স-রে যন্ত্রসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতি। ঔষধাগার ও স্টোরের দেয়াল চুঁয়ে পানি আসছে ভেতরে। হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচতলার ফোরে বৃষ্টির সময় স্যাঁতস্যাঁতে থাকায় সেখানে মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের বাড়তি রোগী রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সংস্কারের তাগিদ দেয়া হলেও দীর্ঘদিন সংস্কার হচ্ছে না। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের দাবি, এই হাসপাতালটি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অংশ। এর রণাবেণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব গণপূর্ত বিভাগের। অন্য দিকে গণপূর্ত বিভাগের দাবি, ২৫০ শয্যার নিচের হাসপাতালের রণাবেণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের। হাসপাতাল কর্তৃপরে অভিযোগ, প্রশাসনিক ভবন, ইমারজেন্সি ভবন, ডায়েরিয়া বিভাগ এবং অপারেশন থিয়েটারের ছাদের পলেস্তরা খসে পড়ে আহত হচ্ছেন চিকিৎসক ও রোগী। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ ও জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা: মু. কামরুল হাসান সেলিম বলেন, নানা সমস্যার কথা ভারপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার জানিয়েছেন। মূলত এর সংস্কারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের। তাদের সাথে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে, অতিদ্রুত কাজ শুরু হবে। আর চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতি সঙ্কটের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।

No comments:

Post a Comment