Wednesday, October 1, 2014

মডেল টেস্টের নামে বাণিজ্যে নেমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো:নয়াদিগন্ত

কোচিং বাণিজ্যের বদলে এবার ‘মডেল টেস্ট’ বাণিজ্যে নেমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কোচিং সীমাবদ্ধ ছিল স্কুলের কিছু ভালো শিক্ষকের মধ্যে। এখন মডেল টেস্ট বাণিজ্যে নেমেছে পুরো প্রতিষ্ঠান। এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন স্কুলের সব শিক্ষক। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতে এর নামকরণ মডেল টেস্ট আর ইংরেজি ভার্সন স্কুলগুলোতে এটি পরিচিত ‘টিউটরিয়্যাল’ নামে। এ মডেল টেস্ট সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক।  পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণীর
শিক্ষার্থীদের মডেল টেস্ট বা টিউটরিয়্যালের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ টাকা শিক্ষকরাই নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। ওই শ্রেণীগুলোর আসন্ন পাবলিক পরীক্ষাকে সামনে রেখে মডেল টেস্ট নেয়া হচ্ছে। তিন শ্রেণীতে অধ্যয়নরত সব শিক্ষার্থীর জন্য মডেল টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর জন্য একেক স্কুলে পরীক্ষার ফির হারও একেক রকম। রশিদ ছাড়াই আদায়কৃত টাকা স্কুলের তহবিলে জমা দিয়ে শিক্ষকেরা নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে কারোরই কোনো নজরদারি বা জবাবদিহিতা নেই। অভিভাবকেরা বলছেন, মডেল টেস্টের নামে আদায়কৃত অতিরিক্ত টাকার হরিলুট হচ্ছে। শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধ এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করতে স্কুলেই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে অতিরিক্ত কাস ও নির্ধারিত হারে ফি নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এরূপ নির্দেশনার প্রতি বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে শিক্ষকেরা মডেল টেস্ট বাণিজ্যে নেমেছেন। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং শিক্ষা বোর্ডগুলো কোনো খবরই রাখেন না বলে জানা গেছে। ওই তিনটি নিয়ন্ত্রক ও তদারকি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা নয়া দিগন্তকে বলেছেন, এ ব্যাপারে কেউ এ পর্যন্ত অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।  অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু বলেছেন, এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাউশি বা বোর্ডের অবশ্যই তদন্ত করা উচিত। মডেল টেস্ট ফি প্রায় পাঁচ হাজার বা দুই হাজার হতে পারে না, যুক্তিযুক্তও নয়।। এ ধরনের পরীক্ষার জন্য ৫০০ টাকা হারে নেয়া যেতে পারে। রশিদ ছাড়া আদায়কৃত টাকা লুটপাট আর ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে। কোথাও এর কোনো জবাবদিহিতা নেই। তিনি জানান, এ চিত্র শুধু রাজধানীতেই নয়। দেশের বড় শহর ও উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থা রোধ করা না গেলে দেশের নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সন্তানদের শিক্ষা দান বন্ধ করে দেয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না অভিভাবকদের।  আগামী নভেম্বরে সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের স্কুলের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হবে। ২ নভেম্বর থেকে শুরু হবে অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। আর পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী শুরু হবে ২০ নভেম্বর থেকে। এ পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের দোহাই দিয়ে মূলত এ মডেল টেস্টগুলো নেয়া হচ্ছে। এখন শুধু যে মডেল টেস্ট নেয়া হচ্ছে তা নয়, কোনো কোনো স্কুলে আরো এক দফায় নেয়া হয়েছে প্রস্তুতি টেস্ট। সে সময়ও অতিরিক্ত ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। অপর দিকে দশম শ্রেণীর স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা হবে আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারিতে। তার জন্য স্কুলগুলোতে প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষার বিধান রয়েছে। কিন্তু এখন যে মডেল টেস্ট নেয়া হচ্ছে এবং অতিরিক্ত ফি দিতে হচ্ছে অভিভাবকদের এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকেরা। বারবার পরীক্ষা নেয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার বোঝা যেমন চাপানো হচ্ছে, তেমনি বারবার পরীক্ষার ফি দিতে গিয়ে ভোগান্তির মুখে পড়ে নাভিশ্বাস উঠেছে অভিভাবকদের। কোনো অভিভাবকের দু’টি শিশু যদি ওই পরীক্ষাগুলোর যেকোনো দু’টিতে অংশ নিতে হয় তা হলে ওই অভিভাবকের নাভিশ্বাস শুধু নয়, তার অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন ছাড়া বিকল্প থাকবে না বলে মত দিয়েছেন ভুক্তভোগী একাধিক অভিভাবক। বাধ্যতামূলক মডেল টেস্ট ফি আদায় সম্পর্কে রাজধানীর শুধু একটি স্কুলের চিত্র হচ্ছে এরূপ : মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের চারটি শাখায় মোট পরীক্ষার্থী (৫ম, ৮ম ও ১০ম মিলে) প্রায় চার হাজারের বেশি। এখানে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে এক হাজার ৫০০ টাকা করে মডেল টেস্টের জন্য দিতে হয়েছে। আর ইংরেজি মাধ্যমের জন্য দিতে হয়েছে দুই হাজার টাকা। এতে প্রায় ৬০ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। জানা গেছে, আদায়কৃত টাকার ১৫ শতাংশ স্কুলের প্রশাসকেরা নেবেন। এ প্রশাসকেরা হচ্ছেন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ, শাখাপ্রধান হিসেবে চারটি শাখার আটজন সহকারী প্রধান শিক্ষক। তারা কোনো কাস বা পরীক্ষা কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেও টাকা পাবেন। অবশিষ্ট টাকা শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হবে নির্দিষ্ট হারে। স্কুলের অধ্যক্ষ পরীক্ষা শুরুর পরপরই দেশের বাইরে (সিঙ্গাপুর) অবস্থান করছেন, তবুও তিনি এ টাকার অংশ পাবেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে এ স্কুলে মডেল টেস্ট শুরু হয়েছে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর তা শেষ হবে। পরীক্ষা শুরুর আগেই এ টাকা আদায় করা হয়েছে। ভিকারুন নিসা নূন স্কুলে মডেল টেস্টের জন্য বছরের শুরুতেই ৪ হাজার ৮০০ টাকা করে অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে। এখানে মডেল টেস্ট শুরু হবে ঈদুল আজহার পরপরই। রাজধানীর প্রতিটি স্কুলেরই এ চিত্র। তবে স্কুলের অবস্থান ও মান ভেদে মডেল টেস্ট ফির হারও কিছুটা কম-বেশি হয়েছে।  এর ব্যতিক্রম নেই রাজধানীর ২৩টি সরকারি স্কুলেও। সেখানেও অনুরূপ টাকা আদায় করা হচ্ছে। মতিঝিল বালক উচ্চবিদ্যালয়ে দুই হাজার ও দুই হাজার ২০০ করে টাকা আদায় করা হয়েছে। ধানমন্ডির গভর্মেন্ট স্কুলের ফি আড়াই হাজার টাকার বেশি। মধ্যবিত্ত ও সরকারি চাকুরেদের সন্তানরাই মূলত সরকারি স্কুলে পড়ে থাকেন। কিন্তু সেখানেও রশিদ ছাড়া অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। মাসিক আট টাকা বেতনের স্কুলে যদি দুই-আড়াই হাজার টাকা অতিরিক্ত ফি আদায় করা হয় তাহলে সেখানকার অভিভাবকদের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ নিয়ে অভিভাবকদের অভিযোগ ও ক্ষোভের অন্ত নেই। তবে, সন্তান স্কুলের শিক্ষকদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা থেকে কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন। সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বর্তমানে সরকারি সফরে অস্ট্রেলিয়া রয়েছেন। মহাপরিচালকের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে মাউশির পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) অধ্যাপক আতাউর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।  এ নিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা তাসলিমা বেগমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম দেখভাল করি। এটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের কাজ। আর্থিক বিষয়াবলি তারাই দেখেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাধ্যতামূলক মডেল টেস্ট নেয়ার কোনো নির্দেশনা রয়েছে কি না? বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব নিয়মে চলে এখানে আমাদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। তারা যদি মনে করেন মডেল টেস্ট নিলে তাদের শিক্ষার্থীরা ভালো করবেন তার জন্য হয়তো নিচ্ছেন। তবে বাধ্যতামূলক করাটা সঠিক নয়। কারণ অতিরিক্ত কাস নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে স্কুলগুলোতে।  এ ব্যাপারে শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতকাল তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ও রশিদ ছাড়া ফি আদায়ে সরকারের পক্ষ থেকে দৃষ্টি রাখার কথা স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির (এসএমসি)। তারাই এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নেবেন এটাই প্রত্যাশা। এ ছাড়া আমাদের কাছে কেউ এ নিয়ে অভিযোগ করেননি। কোনো অভিভাবক লিখিত অভিযোগ করলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।

No comments:

Post a Comment