দেশের উপকূলীয় অঞ্চল জলদস্যু ও বনদস্যুদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। গোটা অঞ্চলে অর্ধশতাধিক দুর্ধর্ষ বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন জেলে ও বনাঞ্চলের খেটেখাওয়া মানুষ। সুযোগ পেলে এরা তীরবর্তী এলাকারও মানুষের ঘরবাড়িতে আক্রমণ চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমন অঞ্চল রয়েছে যেখানে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে চললেও তা প্রকাশ পাচ্ছে না। ভুক্তভোগীরাও অনেক সময় তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের কথা চেপে যাচ্ছেন। এর মধ্যে
কিছু দুর্গম এলাকায় বছরে একবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পা পড়ে না। ওই সব অঞ্চলের মানুষ আরো নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাদের দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, কোনো কোনো এলাকায় দস্যুদের সাথে সখ্য রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন এসব জলদস্যুকে। গোটা উপকূলীয় অঞ্চলেই চলছে দুর্বৃত্তদের তাণ্ডব। সূত্র জানায়, গোটা অঞ্চলজুড়ে অর্ধশতাধিক দুর্বৃত্ত গ্রুপ রয়েছে। যারা জেলে ও বনজীবীদের কাছে চরম আতঙ্কের নাম। এরই মধ্যে পুলিশ ও র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে বেশ কয়েকজন বাহিনী প্রধানসহ অনেক দস্যু নিহত হয়েছে। কিন্তু একটি বাহিনী প্রধান নিহত হলে দেখা যায় আরো একাধিক গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেছে। তখন জেলে ও বনজীবীরা আরো বিপদে পড়ে যান। দেখা যায় আগে যেখানে একটি গ্রুপকে চাঁদা বা মুক্তিপণ দিলে চলত, পরে দিতে হচ্ছে একাধিক গ্রুপকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খুলনা অঞ্চল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ২০টি গ্রুপ। এর মধ্যে চরম দুর্ধর্ষ গ্রুপ রয়েছে অন্তত ১৫টি। এরা সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে বাগেরহাট পর্যন্ত পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। সুন্দরবন ও এর তার আশপাশের নদনদী ও সমুদ্র ঘিরে এদের রাজত্ব। এ অঞ্চলের গ্রুপগুলো হচ্ছে জুলফিকার গ্রুপ, ভুট্টো, শহিদুল, ইলিয়াস, কাশেম, মাইজ্যা, জাহাঙ্গীর, কালা, মামা-ভাগ্নে, আউয়াল, এমদাদুল, বেলাল, রাঙ্গা, শান্ত, রাজু, ফরিদ, হামিদ ও দলু গ্রুপ অন্যতম। স্থানীয় সূত্র জানায়, রাজু বাহিনী এখন কালা বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। রাজু ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সেখান থেকেই সে দস্যু বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে। আর জটিলতা এড়াতে নতুন নাম দিয়েছে কালা বাহিনী। মামা-ভাগ্নে বাহিনীতে খুলনার সরকারদলীয় এক প্রভাবশালী নেতার ভাগ্নে রয়েছে বলে জানা গেছে। খোদ বাগেরহাট এলাকা থেকেই এসব দুর্বৃৃত্ত গত দুই মাসে অন্তত ৩০০ জেলেকে অপহরণ করে। নিয়ে যায় তাদের নৌকা-জাল ও মাছ ধরার সরঞ্জাম। সূত্র জানায়, এর মধ্যে শ’খানেক জেলেকে উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। দেড় শতাধিক মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার হয়েছেন। বাকি অর্ধশত জেলে এখনো নিখোঁজ। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার দেবীপুর গ্রামের এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বেলাল বাহিনী তার ছেলেকে অপহরণ করেছে। মুক্তিপণ হিসেবে এরই মধ্যে ৮০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। আরো এক লাখ টাকা দাবি করছে অপহরণকারীরা। দুই মাস ধরে ওই জেলে নিখোঁজ বলে জানা গেছে। শরণখোলার মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মজিবর রহমান বলেছেন, এভাবে চললে তাদের মাছ ধরা বন্ধ করে দিতে হবে। সূত্র জানায়, এসব দুর্বৃত্তের চাহিদা কমপক্ষে জেলেপ্রতি এক লাখ টাকা। বরগুনা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত অন্তত ২০টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজু, গামা, নাসির, নূর হাবিব, শহিদ, সোবাহান, নানা-মহুবর, বড় ভাই-মাইজ্যা ভাই, কবির, বাদল, মুকুল, সাকাত, আনোয়ার, বেলাল, সজল, জালাল, মাহাতাব, সিদ্দিক, জিহাদ ও বাদল বাহিনী। সাগরে মাছ ধরতে আসা জেলেরা প্রতিবার ইলিশ মওসুমে সাগরে আসার আগে এই বাহিনীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে সদস্য কার্ড সংগ্রহ করতে হয়। যদি কোনো জেলে সদস্য কার্ড না নিয়ে সাগরে মাছ ধরেন তাহলে তাকে হয় প্রাণ হারাতে হয়, না হলে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়। এদের সবারই আস্তানা সুন্দরবনে। গত তিন বছরে এই সুন্দরবনে র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সাথে এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংঘটিত ৩৪টি বন্দুকযুদ্ধে ৫৪ জন জলদস্যু নিহত হয়েছে। র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে সুন্দরবনের আতঙ্ক জুলফু বাহিনী প্রধান জুলফিকারসহ চারজন নিহত হয়। জুলফিকার নিহত হওয়ার পর তার বাহিনীরই আরেক সদস্য গামা বাহিনী নামে আত্মপ্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত গামাও র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। বঙ্গোপসাগরে প্রতি ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মাছ ধরার ভরা মওসুম, এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সুন্দরবনে মধু ও মোম এবং বছরের অন্য সময় গোলপাতা আহরণের মওসুম থাকায় বছরজুড়েই বনে ও জলে দস্যুদের অপতৎপরতা থাকে। দস্যুরা জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি বন বিভাগের বিভিন্ন টহল ফাঁড়িতেও বিভিন্ন সময়ে আক্রমণ করে। আমাদের বরগুনা প্রতিনিধি গোলাম কিবরিয়া জানান, জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জলদস্যুদের কাছ থেকে পাস কার্ড সংগ্রহ করার কথা স্বীকার করে জানান, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরা জেলেদের নিরাপত্তা দিতে না পারায় জেলেরা বাধ্য হয়ে পাসকার্ড সংগ্রহ করছেন। বরগুনা জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মান্নান মাঝি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তারা প্রাণরার্থে জলদস্যুদের টাকা দিচ্ছেন। তিনি আরো জানান, দস্যুকার্ড সংগ্রহ করার পরও জেলেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এক জলদস্যু বাহিনীর কাছ থেকে সদস্য কার্ড সংগ্রহ করলেও আরেক জলদস্যু বাহিনী হামলা ও লুটপাট চালায়। অনেক সময় জলদস্যু বাহিনী দল ও উপদলে ভাগ হয়ে জেলেদের ওপর অত্যাচার চালায়। পাথরঘাটা কোস্টগার্ডের লেফটেন্যান্ট আরিফ হোসেন বলেন, জলস্যুরা জেলেপল্লীতে ছদ্মবেশে ঢুকে দস্যুকার্ড বিতরণ করে বলে আমরা লোকমুখে শুনেছি। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমরা অভিযান চালাব। গত ২ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জলদস্যুরা বঙ্গোপসাগরে রাঙ্গাবালীর ছোটবাইশদিয়ার রুহুল আমিন, মো: কামাল ও মো: লিটন হোসেনকে অপহরণ করে। ৩১ আগস্ট বলেশ্বরের মোহনায় ট্রলারে গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় ডাকাতের গুলিতে জেলে আবদুল মোতালেব নিহত ও আরো চার জেলে গুলিবিদ্ধ হন। কেউবা অপহরণের পর ধারদেনা করে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন। মুক্তিপণ না দিলে জেলেদের হত্যা করে লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়। চলতি ইলিশ মওসুমে পটুয়াখালী জেলায় প্রায় ৬০০ ট্রলারে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। অপহৃত হয়েছেন প্রায় এক হাজার ১০০ জেলে। অপহরণ আর ডাকাতি আতঙ্কে এবার মওসুমের শুরুতে জাল-ট্রলার গুটিয়ে সাগরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন প্রায় ১৫-২০ হাজার জেলে। সূত্র মতে, বঙ্গোপসাগরের ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ঘটে অপহরণ বা ডাকাতির ঘটনা। বিশখালী, বলেশ্বর, পায়রা নদীর মোহনা ও রাঙ্গাবালীর সোনারচরের ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে ডাকাতি-অপহরণের ঘটনা ঘটে বেশি। এসব ঘটনার সাথে প্রায় ২৫টি বাহিনী জড়িত। এর মধ্যে আব্বাস বাহিনী, আকাশ বাহিনী, জুলফিকার বাহিনী, মোতালেব বাহিনী, জিহাদ বাহিনী, কৃষ্ণা-সাগর বাহিনী, রাজু বাহিনী ও আলম মোল্লা বাহিনীর তৎপরতা বেশি। নোয়াখালীর উপকূলজুড়ে ‘বড় হুজুরের’ তাণ্ডব চলছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, এ এলাকায় এমন কোনো কাজ নেই যা ‘বড় হুজুরের’ নির্দেশের বাইরে হয়। সূত্র জানায়, এ এলাকায় কমপক্ষে ২০টি জলদস্যু গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কাজল শেঠ, কাশেম, ইয়াসিন আরাফাত, আলাউদ্দিন, সুলতান ও আবদুল হালিম আজাদ বাহিনী। এদের টোকেন ছাড়া কোনো জেলে নদীতে যেতে পারেন না। র্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, মওসুমভিত্তিক এসব দুর্বৃত্তের অপতৎপরতা বাড়ে-কমে। তিনি বলেন, এদের পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের প্রচেষ্টার কমতি নেই। তিনি বলেন, সব বাহিনী একত্রে কাজ করলে এদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
No comments:
Post a Comment