তুরাগ নদীর তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শত শত কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করেছে এবং করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ। দখলের
পর সেখানে তৈরি করা হচ্ছে দোকানপাট, কাঁচাবাজার ও কাঁচামালের আড়ত। নিচু জমি ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে ট্রাক-বাস ডিপো। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণও বাদ পড়ছে না। দিনে দিনে অবৈধ দখলের আয়তন বাড়ছে। আবদুল্লাহপুর থেকে শুরু করে কামারপাড়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার নদীপারে এ দখলকাণ্ড চলছে। অভিযোগ উঠেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (ডাব্লিউডিবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশেই দখল চলছে। সরকারের জমি দখল করছে সরকারি দলেরই লোকজন। গড়ে ওঠা বাজার, আড়ত ও অন্যান্য স্থাপনা থেকে দখলদাররা মাসিক ভাড়া নিচ্ছেন। বরাদ্দ বাবদ অগ্রিম টাকা নিয়েছেন। কোটি কোটি টাকা তাঁরা আয় করেছেন এবং করছেন। স্লুইসগেট এলাকায় আবদুল্লাহপুর খালের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের এক নেতার দখলের কারণে। নদ ও খালের সংযোগস্থলে কাঁচাবাজার, দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তুরাগ থানার হরিরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা আল আমিন। তিনি তাঁর বাবা তৈয়ব আলীর নামে কাঁচাবাজারটির নামকরণ করেছেন। আল আমিন দাবি করেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জমি লিজ নিয়ে তিনি মার্কেট নির্মাণ করেছেন। কিন্তু লিজের কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে রাজি হননি। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মার্কেট বা দোকানপাট নির্মাণের জন্য তাঁরা কোনো জমি লিজ দেন না। তবে জনস্বার্থে রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য কিছু জমির একসনা (এক বছরের জন্য) লিজের ব্যবস্থা রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, আল আমিন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় এক একর জমি দখল করেছেন। এতে আবদুল্লাহপুর খাল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কাঁচাবাজার থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আবর্জনা ফেলা হচ্ছে খালে। এতে খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আল আমিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্থানীয় আরো অনেকে সেখানে সরকারি জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। তাঁদের একটাই পরিচয়- তাঁরা সরকারি দলের লোক। অনুসন্ধানকালে আরো জানা গেছে, হরিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আবুল হাশেমের নাম ভাঙিয়ে তুরাগতীরে দখলবাজি চলে। তিনি স্থানীয় এমপি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ঘনিষ্ঠ। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও তাঁকে ঘাঁটান না। দখলকৃত জায়গায় গড়ে ওঠা ৫০টি দোকান থেকে অগ্রিম বাবদ নেওয়া হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। প্রতি মাসে ভাড়া তোলা হচ্ছে দোকানপিছু ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। দোকানদার শাহ আলম বলেন, জমির প্রকৃত মালিক কে তিনি জানেন না। তবে তিন লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে দোকান নিয়েছেন। মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিচ্ছেন আল আমিনকে। একাধিক দোকানদার ভাড়া ও অগ্রিমের কথা স্বীকার করেছেন। অনুসন্ধানকালে দেখা গেল, খালের মুখে একটি দোতলা মসজিদ। এর নাম স্লুইস গেট জামে মসজিদ। প্রতিষ্ঠার সাল ১৯৯৭ উল্লেখ রয়েছে। মসজিদের গা ঘেঁষে কয়েকটি দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর কারণে খালটি বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা কাজী ইদ্রিস আলী বলেন, আশপাশে একাধিক মসজিদ রয়েছে, এর পরও সরকারি জমিতে বিনা অনুমতিতে কেন এ মসজিদ করা হলো তা বোধগম্য নয়। মসজিদের উত্তর পাশে একটি টয়লেট রয়েছে। সেটি বাণিজ্যিকভাবে চালানো হচ্ছে। মসজিদের খাদেম পরিচয়দানকারী আবদুস সালাম বলেন, পরিচালনা কমিটির সভাপতি নাসির মেম্বারের নির্দেশে তিনি টয়লেট ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। ইমাম জুবায়ের আহমেদ বলেন, মসজিদটি বোর্ডের জমির ওপর নির্মাণ করা হলেও এর জন্য তাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। আবদুল্লাহপুর খালের কাছেই তুরাগতীরে কয়েক বিঘা জমি দখল করেছেন উত্তরা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মো. মুহিত আলম। নিচু এই জমি ভরাট করে বালুমহাল বানিয়ে ব্যবসা করছেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি দুই বিঘা জমি ভরাট করে তিনি ‘বিসমিল্লাহ ফলমূল ও কাঁচামালের আড়ত’ গড়ে তুলেছেন। প্রায় ৬০টি আড়ত ঘর বরাদ্দ দিয়ে এক কোটি ২০ লাখ টাকা জামানত নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার প্রতি আড়ত থেকে মাসে ভাড়া নিচ্ছেন ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আবদুল্লাহপুর খাল ও তুরাগ নদের সংযোগস্থলে কমপক্ষে ২০টি বড় বালুর গদি রয়েছে। সবই অবৈধ। সেখানে জাকির হোসেন নামে একজনেরও বালুর বিশাল গদি রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাকির হোসেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা মুহিত আলমের ভাতিজা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনেক সম্পত্তি চাচা-ভাতিজার দখলে থাকার অভিযোগ রয়েছে। জাকির বলেন, তিনি কোনো সরকারি জমি দখল করেননি। চাচার কাছ থেকে বার্ষিক চার লাখ টাকা ভাড়ায় জায়গা নিয়ে বালুর গদি চালাচ্ছেন। অভিযোগ সম্পর্কে মুহিত আলম বলেন, সেখানে তাঁর কিছু পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে। এর সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৮.৯৩ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে তিনি কাঁচামালের আড়ত গড়ে তুলেছেন। তবে বোর্ডের জমি আড়ত নয়, রাস্তা নির্মাণের জন্য লিজ নিয়েছিলেন বলে তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আরো অনেকে এক কাজের জন্য জমি লিজ নিয়ে আরেক কাজ করছেন। এসব বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করার অনুরোধ জানান তিনি। স্থানীয় সূত্র জানায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতার জোরে মুহিত পুরান ঢাকার এক ব্যক্তির প্রায় এক বিঘা জমি দখল করে বাস ডিপো বানিয়েছেন। এ অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ডিপোর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। বাস ডিপোটি বাস সমিতির লোকজন মাটি ভরাট করে নির্মাণ করেছে। এ ব্যাপারে ইয়াসিন নামে এক বাস শ্রমিক বলেন, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এখানে ভরাট বা দখলের ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। অনুসন্ধানকালে ওই ডিপোতে খেয়া পরিবহনের কয়েকটি গাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেশকিছু জমি মনজিল পরিবহন এবং আহ্ছানিয়া মিশনের ক্যান্সার হাসপাতালের দখলে রয়েছে বলে বোর্ডের একটি সূত্র জানায়। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও বোর্ড ওই জমি উদ্ধার করতে পারেনি। মনজিল পরিবহন ও আহ্ছানিয়া মিশন থেকে বলা হয়েছে, তারা বোর্ড থেকে যথাক্রমে ১৭ ও ১০ শতাংশ জমি একসনা লিজ নিয়ে ব্যবহার করছে। মনজিল পরিবহনের শেয়ারহোল্ডার আবদুল বাকির বলেন, তাঁদের গাড়ি রাখার জন্য জমি লিজ নেওয়া হয়েছিল। এখন পরিবহনের ব্যবহার নেই। তাই খালি জায়গায় বালু রাখা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, তুরাগতীরে আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়ক ঘেঁষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শত শত কোটি টাকার জমি দখল করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বস্তিঘর নির্মাণ করেছেন। সেসব ঘর নিম্ন আয়ের লোকজনের কাছে ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন তাঁরা। সেখানে মসজিদ-মাদ্রাসা, এনজিও স্কুলের স্থাপনাও রয়েছে। বস্তিবাসী আমেনা বেগম বলেন, সরকারি দলের নেতাদের হাত না থাকলে এক দিনও বস্তিগুলো টিকত না। কুদ্দুস মিয়া বলেন, রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও বোর্ডের কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মাসোয়ারা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়। আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের উত্তর পাশে বিশাল বস্তির মধ্যে একটি মাদ্রাসা দেখা গেল। নাম বিশ্বনবী (সা.) দারুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা। সাইনবোর্ডে এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮০ লেখা। বোর্ডের প্রায় এক বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হলেও এর জন্য বোর্ড থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, বস্তিঘরগুলো টিকিয়ে রাখার জন্যই এ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রিন্সিপাল আবদুল কাদির বলেন, মাদ্রাসাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমিতেই গড়ে উঠেছে। তবে অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না তা তিনি বলতে পারেননি। আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশেই পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও জনপথের প্রায় তিন বিঘা জমিতে গড়ে উঠেছে সুলতান শাহ ও তরুণ শাহ নামের দুটি মাছের বাজার। সেখানে প্রায় ১৫০টি আড়ত রয়েছে। মার্কেটের সেক্রেটারি সুলতান সিকদার বলেন, সুলতান শাহ ও তরুণ শাহ মার্কেটের মালিক। তাঁরা প্রতিদিন রসিদের মাধ্যমে আড়তপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়া আদায় করেন। স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, এই তিন বিঘা জমির অধিকাংশ সরকারি। দুই মালিককে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। মার্কেটের ব্যবস্থাপক রাসেল বলেন, এটা দুই ভাইয়ের পৈত্রিক সম্পত্তি। সরকারি সম্পত্তি খালি রেখেই তাঁরা মাছের আড়ত করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আফজাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, তুরাগ ছাড়াও আরো অনেক নদ-নদীর তীরে তাঁদের অনেক জমি দখল হয়ে গেছে। অনেকে সামান্য জমি লিজ নিয়ে বিশাল পরিমাণ জমি দখলে রেখেছেন। কেউ কেউ সেখানে অবৈধভাবে ভবন ও দোকানপাট করেছেন। এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। এসব জমি জরিপ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জরিপ শেষে বোর্ডের জমি উদ্ধার করা হবে।
No comments:
Post a Comment