Monday, January 5, 2015

দেশজ ঐতিহ্যে লীন তাইওয়ানের মুসলিম সমাজ:নয়াদিগন্ত

তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের গ্রান্ড মসজিদে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে কমপক্ষে এক হাজার মুসলিম একত্র হয়। তাদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ স্থানীয় তাইওয়ানিজ; অন্যরা ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলমান।   তাইপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এ মসজিদটি ১৯৬০ সালে জর্দানের বাদশাহ ও ইরানের শাহের আর্থিক সহায়তা এবং স্থানীয়দের দানে নির্মিত হয়। এটি সৌদি আরবের সাথেও এখানকার
সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। ১৯৭১ সালে সৌদি বাদশাহ ফয়সালের তাইপে সফর তারই ইঙ্গিত বহন করে। স্বশাসিত এই চীনা দ্বীপটির শতকরা ৯০ ভাগ অধিবাসী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।   মসজিদের চেয়ারম্যান ওমর ইয়াংয়ের মতে, নতুন প্রজন্মের ইসলামি শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাব এবং চীনা সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে ইসলামি রীতিনীতি পালন কমে যাচ্ছে এখানে। তাদের ধর্মবিশ্বাসের বিষয়ে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।   আলজাজিরা সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইয়াং তাইওয়ানের মধ্যাঞ্চলের এমন একটি পরিবারের কাহিনী বর্ণনা করেন যাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মুসলমান। তারা বিভিন্ন ইসলামি রীতি পালন করে যাচ্ছেন। তারা শূকরের মাংস খান না। তবে তাদের কখনোই এ ধরনের জীবনযাপন সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি।   একদিন তারা চীনের একটি পারিবারিক সমাধি ক্ষেত্রে তাদের পূর্বপুরুষদের দান করা কিছু বস্তু দেখতে পান। এর মধ্যে একটি আরবি কুরআন শরিফও ছিল। তবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ইসলামের জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না, এটিকেই তাইওয়ানের মুসলমানদের আসল সমস্যা বলে মনে করেন ইয়াং।   গৃহযুদ্ধ   তাইওয়ান আগে ফরমোজা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রথম মুসলমানরা কিং রাজবংশের সাথে ১৬৮৩ সালের দিকে এ দ্বীপে আসেন বলে মনে করা হয়। তবে পরবর্তীতে তাদের বেশির ভাগই মূলধারার চীনা সংস্কৃতিতে মিশে যায় এবং ইসলামি বিধান পালন থেকে দূরে সরে যায়। তাইওয়ানিজ মুসলিমদের বেশির ভাগই চিয়াং কাইশেক-এর নেতৃত্বাধীন চাইনিজ ন্যাশনালিস্ট পার্টি কৌমিনটাংয়ের সৈন্যদের ছেলে কিংবা নাতিনাতনী। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে পরাজিত হওয়ার পর তারা এখানে বসবাস শুরু করে। তারা সাধারণত হুই মুসলিম নামে পরিচিত। দ্বীপটির মোট ৬০ হাজার হুই বাসিন্দার মধ্যে ২০ হাজার হলো মুসলমান। ২০১২ সালে পিউ রিসার্স সেন্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে মোট ২০ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার শতকরা শূন্য দশমিক এক ভাগ মুসলমান। ‘তাইওয়ানিজ জাতি হিসেবে টিকতে চাওয়ার প্রবণতাই মূলত ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি এখানকার জনগণের অনাগ্রহের মূল কারণ’ বলে মনে করেন ইয়াং। তাইওয়ান জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্র নয়, চীন থেকে আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র্র হিসেবে এর মর্যাদা একটি বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু। কমিউনিস্ট শাসিত চীনের সাথে রাজনৈতিকপর্যায়ের দূরত্ব বজায় রাখায় চেষ্টা করে আসছে তাইওয়ান। তাইওয়ানের একটি বড় অর্জন হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসনের ধারা অনুসরণ যাতে ইসলামসহ ২৬টি ধর্মকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাইওয়ানের মুসলমানরা ‘হুই জিয়াও’ নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত।   ধর্মীয় সহিষ্ণুতা   পিউ রিসার্স সেন্টারের ২০১৪ সালের ধর্ম ও জনজীবন প্রকল্পের এক রিপোর্টে তাইওয়ানকে বিশ্ব ধর্মীয় বৈচিত্র্য সূচকে দ্বিতীয় স্থান প্রদান করা হয়। এ তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর।   ‘তাইওয়ান খুবই সহিষ্ণু একটি স্থান’ বলছিলেন ২৮ বছর বয়সী তরুণ ডিজাইনার আনাস চাও, যার পরিবার কেএমটির সাথে এই দ্বীপে আসে। যদিও তার বক্তব্য অনুসারে স্থানীয় তাইওয়ানিজ সংস্কৃতিতে আঘাত না করে এমনভাবে ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখা ও প্রসার করা মুসলমানদেরই দায়িত্ব। যদিও বেশির ভাগ তাইওয়ানিজ তাদের অবসরে ধর্মীয় চর্চার চেয়ে বার কিংবা নৈশকাবে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করেন।   ২১ বছর বয়সী তরুণী শরিফা ইয়াং আল জাজিরাকে বলেন, ‘তাইওয়ানে বেড়ে ওঠার ফলে আমি তাইওয়ানিজ সংস্কৃতির সাথে ইসলামের একটি বিরোধ দেখতে পাচ্ছি এবং এ নিয়ে আমি প্রায়ই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ি। এটা এখানকার তরুণদের মধ্যে মুসলিম সংস্কৃতির চেয়ে তাইওয়ানিজ সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা তৈরি করে। তাইওয়ানিজ সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ও মসজিদে না আসার কারণে তরুণ মুসলিমদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে অনাগ্রহ থেকে তাদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ে অজ্ঞতার সৃষ্টি হচ্ছে, এ ছাড়া তারা এমনটিও মনে করে যে, ধর্মবিশ্বাস থেকে তারা তেমন কিছু অর্জন করতে পারবে না বরং কঠোর পরিশ্রম, সম্পদ ও মর্যাদা লাভের সমন্বয়ে গঠিত তাইওয়ানিজ সংস্কৃৃতিতে তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে।’   মুসলমানদের অভিবাসন   তাইওয়ানে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নতুন করে তাইওয়ানিজদের ইসলাম গ্রহণ ও অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ওপর। এখানকার বর্তমান অভিবাসীদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ান মহিলা গৃহকর্মী। তাইওয়ানে বর্তমানে তাদের সংখ্যা দুই লাখের বেশি। ইন্দোনেশিয়ানদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে তাইপে গ্রান্ড মসজিদে মান্দারিন ও আরবি ভাষার পরেই ইন্দোনেশিয়ান বাহাসা ভাষা সর্বাধিক ব্যবহৃত হচ্ছে। তাইপে গ্রান্ড মসজিদের ইমাম সিরিয়ান বংশোদ্ভূত ওমর আয়াশ বলেন, ‘অতীতের প্রথাগত জীবনধারায় অনভ্যস্ত তরুণ প্রজন্মকে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া তুলনামূলক সহজ।’ প্রবীণদের তাদের রীতিনীতি লঙ্ঘন না করে ইসলাম শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাইওয়ানে ইসলাম কনফুসিয়াসবাদ, বৌদ্ধধর্ম ও তাওই মতবাদের সাথে মিশে গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসীদের মাধ্যমে দেশটিতে একটি ভিন্ন ধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থান তৈরি হচ্ছে।’   আনাস চাও আলজাজিরাকে বলেন, ‘ধীরে ধীরে জাপান ও কোরিয়ার মতো স্থানীয় মুসলিমদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে যারা কেএমটির সাথে এসেছিলেন। এখন বিদেশীরা এসে এই সংখ্যা বৃদ্ধি করছেন। ফলে চীনা মুসলিমদের স্থান দখল করছে তাইওয়ানিজ-ইন্দোনেশিয়ান, তাইওয়ানিজ-পাকিস্তানি, তাইওয়ানিজ-মরোক্কান ইত্যাদি নতুন ধারার মুসলিম সমাজ।’  সূত্র: আলজাজিরা   অনুবাদ: আহমেদ বায়েজীদ

No comments:

Post a Comment