Monday, November 10, 2014

অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ:নয়াদিগন্ত

বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়নের সময়সীমা শেষ হয়েছে গত জুনে। এরপর ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতারও কোনো পরিবর্তন আসেনি। গতি ফেরেনি নতুন বিনিয়োগের। জুনের আগে যেসব ঋণ অনেকটা ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন হয়েছিল ওই সব ঋণের কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় আবার তা খেলাপিতে রূপান্তর হচ্ছে। সব মিলে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আনেক বেড়ে গেছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন
ই আভাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ওই সূত্র জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী সাপ্তাহেই তা চূড়ান্ত করা হবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ সঙ্কটের পাশাপাশি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা স্থায়ী হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের অনেকেই ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছেন না। নতুন করে নাম লেখাচ্ছেন ঋণখেলাপির খাতায়। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় আছেন, মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের পুঁজি কম। অনেকেরই পুঁজি আটকে যাওয়ায় নতুন করে আর বিনিয়োগ করতে পারছেন না। সব মিলে ব্যাংকিং খাতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, এক দিকে ব্যাংকের ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে, অপর দিকে নতুন করে কেউ ঋণ নিচ্ছেন না। বিনিয়োগ স্থবিরতায় ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। কিন্তু পরিচালনব্যয় কমছে না, বরং দিন দিন বেড়ে চলেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাদি বৃদ্ধিসহ অফিসভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন সেবা বিল বাড়ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা ও ওত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তৎকালীন বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার নামে খেলাপি ঋণের নীতিমালায় শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরে ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া অনেকটা ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই খেলাপি ঋণ নবায়ন করেন। ফলে ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সূত্র জানিয়েছে, গত জুন পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়। কিন্তু ঋণ নবায়নের এ বিশেষ সুবিধা গত জুনে শেষ হয়।  ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণ নবায়নের বিশেষ সুবিধা গত জুনে শেষ হলেও এর পর ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। স্থবিরতা কাটেনি বিনিয়োগের। ফলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়েনি, বরং অব্যাহতভাবে ব্যবসায় লোকসান দিতে দিতে তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আরো কমে গেছে। কিন্তু জুনের আগে যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়েছে সেগুলো জুনের পরে আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে। সব মিলে বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ আবার বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকাই মন্দ ঋণ, যা প্রায় আদায় অযোগ্য।  ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকের সরাসরি মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। খেলাপি ঋণের শ্রেণিভেদে ব্যাংকগুলোর ২৫ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। অপর দিকে মন্দ ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলো আয় হিসেবে দেখাতে পাারে না। এ সুদ স্থগিত করে রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুন শেষে ২৬ হাজার কোটি টাকার প্রভিশণ সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকিং খাত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে। অর্থাৎ ৩০ হাজার কোটি টাকাই ব্যাংকের আয় খাত থেকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মন্দঋণের বিপরীতে আট হাজার কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়। এ কারণে যে ব্যাংকের যত বেশি খেলাপি ঋণ, তত বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। অপর দিকে খেলাপি ঋণ বেশি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ব্যাংকগুলোর বার্ষিক মানদণ্ডে খারাপ অবস্থানে চলে যায়।  ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যবসাবাণিজ্যের মন্দার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার পরিপালন করতে গিয়েও ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। নিয়মের ফাঁদে আটকে যাচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। আগেভাগেই ঋণখেলাপির খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। আর ঋণখেলাপি হলে ব্যাংক থেকে আর নতুন করে ঋণ নিতে পারছেন না। এতে যে ব্যবসায়ী একবার ঋণখেলাপি হিসেবে নাম লেখাচ্ছেন তিনি আর সহজেই বের হতে পারছেন না। বিষয়টি সুরাহা করতে আদালতে গড়াচ্ছে। গতকাল কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, গত সেপ্টম্বর শেষে তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। চলমান ব্যবসাবাণিজ্যের মন্দার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাদেরকে আরো সঙ্কটের মুখে ফেলে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সামনে সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। দেশের প্রতিষ্ঠিত এক জন শিল্প উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধা না পাওয়ায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না। এর পাশাপাশি যেগুলো চালু আছে সেগুলোরও শতভাগ উৎপাদনক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। কেউ বা ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ফার্নেস ওয়েল ও ডিজেল ব্যবহার করছে। কেউ জেনারেটর চালিয়ে মিল সচল রাখছেন। এতে উৎপাদনব্যয় বেড়ে গেছে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাদের ব্যবসার ব্যয় বেড়ে চলছে। এসব কারণে তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। নাম লেখাচ্ছেন ঋণখেলাপির তালিকায়। এ দিকে ঋণ আদায় করতে না পারায় ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ঋণ আটকে পড়ায় ব্যাংকও নতুন করে ঋণ দিতে পারছে না। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও দিন দিন কমে যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment