বেনারসি তাঁতিদের জন্য মিরপুরের ভাষানটেকে একটি পল্লি গড়ে তোলার সরকারি উদ্যোগ ১৯ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। এ জন্য ৪০ একর জমিও বরাদ্দ দেওয়া আছে। কিন্তু ওই জায়গা অবৈধভাবে দখলে রেখেছে বস্তিবাসীরা। তাদের পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। তবে জায়গার সমস্যা ছাড়াও মিরপুরের বেনারসির আগের সেই রমরমা অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন তাঁত
ি ও ব্যবসায়ীরা। ভাষানটেকের পল্লিতে জায়গার পাশাপাশি তাঁরা নকশা-প্রশিক্ষণ আর কম দামে সুতা পাওয়ার ব্যাপারেও সহায়তা চাইছেন। সরেজমিন ভাষানটেক পল্লি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জায়গাটিকে নানাভাবে দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দোকান, বস্তি, সিএনজি, রিকশা, অটোরিকশার গ্যারেজ। দখলদারদের কাছ থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে আবার অনেকেই তাঁত চালাচ্ছেন। তাঁত বোর্ডের হিসাবে, সেখানে অবৈধ বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ১০০। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। এ বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান অসিত কুমার মুকুটমণি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা হওয়ায় জায়গার কোনো দলিল আমরা বুঝে পাইনি। এ কারণে বেশি কিছু করতে পারছি না। মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’ তিনি জানান, মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে বোর্ডের একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। তৃণমূল পর্যায়ের তাঁতিরা নতুন করে এ পেশায় আসছেন না উল্লেখ করে মিরপুর বেনারসিপল্লি তাঁতি পরিবারকল্যাণ সংস্থার সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ অবস্থায় সরকারিভাবে তাঁতিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিলে একসময় হয়তো আর কোনো তাঁতিই থাকবেন না।’ বেনারসিপল্লি ঝুলে আছে ১৯ বছর: ভাষানটেকের পল্লির প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে তাঁত বোর্ড প্রকল্পটির কাজ শুরু করে। ব্যয় ধরা হয় ২৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বরাদ্দ হয় ২৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এ থেকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে ২৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা দেয় তাঁত বোর্ড। ২০০৭ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাটি ভরাটের ৮৬ শতাংশ ও সীমানাপ্রাচীরের ১৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তাঁত বোর্ড বলছে, প্রকল্প এলাকায় আগে থেকেই অবৈধ বস্তি ছিল। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম দখলদার বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আবার বস্তি গড়ে ওঠে। পুনর্বাসন না করেই বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে—এ অভিযোগে তখন উচ্ছেদ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পাঁচ ব্যক্তি রিট করেন। ২০০৩ সালে এই রিট খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এরপর গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ফের বস্তি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলে তা ঠেকাতে আরেকটি রিট করেন হাছিনা বেগম নামের একজন বস্তিবাসী। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালে থেকে বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। এরপর প্রকল্পের কাজ এগোয়নি। ভাষানটেকের পল্লিতে ৯০৬টি তাঁতি পরিবারের আবাসন ও কারখানা স্থাপনের সুযোগ থাকবে। এখানে তাঁতিরা ৩ শতাংশ করে প্লট পাবেন। প্লটের জন্য এক হাজার ৮৬৬ জন তাঁতি আবেদন করেছিলেন। ২০০৩ সালে প্রত্যেক তাঁতির কাছে ১০ হাজার টাকা করে জামানত নেওয়া হয়। অবশ্য ২০০৮ সাল থেকে তাঁতিরা তাঁদের জামানত তুলে নিতে শুরু করেন। এখন পর্যন্ত ৪৪ জন তাঁতি জামানত তুলে নিয়েছেন। ভাষানটেকের পল্লিতে প্লটের জন্য আবেদন করেছিলেন মোহাম্মদ সেলিম। এখন তিনি দখলদারের কাছ থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে তাঁত চালাচ্ছেন। জানালেন, তিন বছর ধরে তিনি এখানে দুটি তাঁত চালাচ্ছেন। ঘরটির ভাড়া এক হাজার ৪০০ টাকা। জায়গার মালিক কে, কাকে ঘর ভাড়া দেন? জানতে চাইলে তিনি জানান, মোহাম্মদ নাসির নামের এক লোকের কাছ থেকে এ জায়গা ভাড়া নিয়েছেন। নাসিরের দখলে আছে দুই কাঠার বেশি জায়গা। একজন তাঁতিকে পাওয়া গেল, যিনি জায়গা দখল করে চারটি তাঁত চালাচ্ছেন। পাশাপাশি দুটি ঘরে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। জানালেন, প্লটের জন্য আবেদন করেছিলেন, এখনো জায়গা বুঝে পাননি। ২০০০ সালে নিজেই এখানে জায়গা দখল করে বসবাস করছেন। সাংবাদিক পরিচয় শোনার পর আর কথা বলতে রাজি হননি তিনি। বরাদ্দ না পেয়ে যেসব তাঁতি ভাষানটেকে পল্লির জায়গা দখল করে বসবাস করে আসছেন, তাঁদের একটি সমিতি আছে। নাম ‘ভাষানটেক প্রাথমিক তাঁতি পুনর্বাসন সমিতি’। এটি অবশ্য নিবন্ধিত সমিতি নয়। সমিতির সভাপতি মনির মুন্সি বলেন, ‘জায়গা বুঝে পাওয়ার জন্য চেষ্টা তো কম করলাম না। কিছুতেই কিছু হইতাছে না।’ সুতার দামে পোষায় না: মিরপুরের বেনারসি তাঁতি এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁদের শাড়ির সুদিন ফিরিয়ে আনার পথে বড় বাধা এখন সুতা। শাড়ি বুনতে তাঁরা যে সিল্কের সুতা ব্যবহার করেন, তা চীন থেকে আমদানি করা হয়। ২০০৯ সালে তিন হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে যে সুতা কেনা যেত, এখন তা কিনতে খরচ পড়ছে সাড়ে ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টাকা। এতে শাড়ির দামও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে একই মানের ভারতীয় শাড়ির চেয়ে এর দাম এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি হয়ে যাচ্ছে। ছয়টি তাঁতের মালিক মনির হোসেন মুন্সি বলেন, সুতার দাম বেশি হওয়ায় শাড়ি বিক্রি করে এখন আর তেমন লাভ হয় না। একটি জুট কাতান শাড়ি চার হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা লাভ থাকে। আর একটি জংলা কাতান শাড়ি ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করে লাভ থাকে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। মিরপুরের বেনারসি শাড়িগুলো ঘুরে-ফিরে একই নকশায় হয়ে থাকে, বৈচিত্র্যও কম। একই নকশা ব্যবহারের কারণে তা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে না। বিষয়টি স্বীকার করে মিরপুর বেনারসি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ রফিক প্রথম আলোকে বলেন, এখনকার শাড়ির নকশাগুলোর বেশির ভাগই ভারতের বেনারসির নকল করে করা হয়। নিজেদের কোনো উদ্ভাবন নেই। ভাষানটেকের পল্লিতে প্লট পাওয়া তাঁতিদের শাড়ি বোনার উপকরণ, ঋণ এবং প্রশিক্ষণ ও নকশাসহ অন্যান্য কারিগরি সেবাও দেওয়ার কথা। কিন্তু পল্লি ঝুলে থাকায় এসব সুবিধা থেকেও বঞ্চিত তাঁতিরা।
No comments:
Post a Comment