গত ছয় মাসে শুধু ঢাকা মহানগরে পুলিশ কমিশনারের আট শতাধিক আদেশ অমান্য করা হয়েছে। কোনো কোনো কর্মকর্তাকে তিন-চারবার লিখিত আদেশ দিয়েও কাজ হয়নি। একটি গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশে শৃঙ্খলা অমান্য করার এমন উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তর থেকে
এ বিষয়ে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক খান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদনটি তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। যাঁরা আদেশ অমান্য করে পুলিশের ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগরে একশ্রেণির পুলিশ সদস্য দীর্ঘদিন ধরে এক জায়গায় থাকেন। তাঁরা অবৈধভাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। আবার সেই টাকা বিভিন্ন স্তরে উৎকোচ দিয়ে পছন্দের জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া পুলিশের কিছু দলবাজ এবং বিশেষ জেলার পুলিশ সদস্যরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। ফলে তাঁদের কাছ থেকে জনগণ সঠিক সেবা পায় না। বিশেষ জেলার নাম ভাঙিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের মতাদর্শীরাই বিশেষ সুবিধা নিচ্ছেন। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে পুলিশ র্যাবকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে বলে উভয়ের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। বিভিন্ন সময় র্যাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলে পুলিশ সদস্যরা উল্লসিত হন। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান বলেন, তাঁরা এ ধরনের প্রতিবেদন সম্পর্কে অবহিত নন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর আটটি অপরাধ বিভাগে পুলিশের উপকমিশনারের দপ্তরে পাঁচ শতাধিক অভিযোগ মাসের পর মাস ফাইলবন্দী হয়ে আছে। এ বিষয়ে সংশিষ্ট উপকমিশনাররা কোনো ব্যবস্থা নেননি। বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশসহ সহকারী পুলিশ কমিশনার ও পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনারের দেওয়া অর্ধশতাধিক তদন্ত প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে দলবাজ পুলিশ সদস্যরা আরও বেশি অপরাধে মেতে উঠলেও বরাবরই তাঁরা বিভাগীয় শাস্তির বাইরে থাকার ফলে চাকরিবিধি লঙ্ঘনসহ শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ থামানো যাচ্ছে না। কয়েকটি উদাহরণ: গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গুলশান থানার এক সহকারী পরিদর্শকের বদলির আদেশকে ঘিরে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে পাঁচটি আদেশ জারি করতে হয়েছে। গুলশান থানায় কর্মরত এসআই বোরহান রানাকে জুনের প্রথম সপ্তাহে ডিএমপি কার্যালয়ের এক আদেশে বনানী থানায় বদলি করা হয়। সেখানে তিনি যোগ না দিয়ে বিভাগে যোগদানের আগেই ‘অপরাধ অফিসার’ পদটি লাভের চেষ্টা চালান। তা সম্ভব না হওয়ায় দুই দিনের মধ্যেই আবার তাঁর বদলির আদেশ বদল করে গুলশান ডিসির দপ্তরে সংযুক্ত হওয়ার নতুন আদেশ করান এবং পরবর্তী ২৪ দিনের মধ্যেই তিনি ভাটারা থানায় অপারেশন অফিসারকে সরিয়ে ওই পদে নিজের পোস্টিং-সংক্রান্ত আরেকটি আদেশ করাতে সক্ষম হন। জানতে চাইলে বোরহান তাঁর বারবার বদলি হওয়ার কথা স্বীকার করেন। এ রকম আরেকটি উদাহরণে দেখা যায়, গুলশান বিভাগের রিজার্ভ অফিসার এসআই নুরুল হুদাকে বদলি করা হয় পুলিশের বিশেষ শাখায়। তিনি সেই আদেশ বাতিল করিয়ে আগের জায়গায় বহাল থাকতে সক্ষম হন। পুনরায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে রাজশাহী রেঞ্জে বদলির আরেকটি আদেশ জারি করে। কিন্তু এবারও নুরুল হুদা আদেশ বাতিল করান এবং নতুন আরও একটি আদেশ জারির মাধ্যমে ঢাকা রেঞ্জে পছন্দের স্থানে পোস্টিং নিশ্চিত করেন। তাঁর বদলির আদেশটি কার্যকর করতেও কর্তৃপক্ষকে অন্তত তিনটি আদেশ জারি করতে হয়। যোগাযোগ করা হলে এসআই নুরুল হুদা বলেন, এটা ঠিক যে ঢাকায় থাকার জন্য তিনি তদবির করেছেন। কারণ, তাঁর স্ত্রী ঢাকার একটি স্কুলের শিক্ষক। আর তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। বনানী থানার এসআই জুলফিকারকে ডিএমপি কর্তৃপক্ষ বদলির আদেশ দিলেও তা নয় মাস ধরে ঝুলে থাকে। পরে তিনি নিজের পছন্দমতো স্থানে পোস্টিংয়ের আদেশ করিয়ে নিয়েছেন। একইভাবে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে বারবার আদেশ জারি করেও দুই শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে কর্তৃপক্ষের পছন্দের স্থানে বদলি করা সম্ভব হয়নি। আরও দুই শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা অফিস আদেশ লঙ্ঘন করে নিজেদের পছন্দমতো স্থানেই বহাল রয়েছেন। আবার সকালে বদলির আদেশ জারি হলেও বিকেলেই আদেশ বাতিল হয়ে আগের স্থানে ফিরে গেছেন—এমন উদাহরণও আছে। গুলশান থানার এএসআই শহীদ সকালে গুলশান ফাঁড়িতে যোগ দিলেও বিকেলে আরেকটি আদেশ জারি করিয়ে গুলশান থানায় ফিরে আসতে সক্ষম হন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু রাজধানীতেই নয়, সরকারি আদেশ অমান্য করার নজির আছে সারা দেশেই। কুমিল্লার দেবীদ্বার থানার অপারেশন অফিসার হিসেবে কর্মরত এসআই নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। কিন্তু এক বছরেও তাঁকে বিভাগীয় কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিএমপি অ্যাক্ট-২০০৬-এর (চ) উপধারায় কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশ অমান্যকারীকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিভাগীয় শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনা হয় না। প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি বিশেষ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই সর্বাধিক অপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগ উঠেছে। যেসব কর্মকর্তা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা জুটিয়ে নেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই মানুষকে হয়রানি, পুলিশকে বিতর্কিত করে তোলা ও নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
No comments:
Post a Comment