মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় আরেক দফা বাড়ছে। মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সম্প্রসারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব এলাকা। সমীক্ষায় এসেছে, ডিপোর জন্য নির্ধারিত স্থানের মাটির যে ধরন, তা ভূমিকম্প সহনশীল নয়। এ অবস্থায় ডিপো এলাকার মাটি উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ কারণেই প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে। তবে কত বাড়ছে সে হিসাব এখনো করা হয়নি। এদিকে স
র্বশেষ নকশা অনুসারে মেট্রোরেল সংসদ ভবন এলাকার খেজুরবাগানের ৫৫ মিটার বা প্রায় ১৮৩ ফুট ভেতর যেতে হবে। এর ফলে লুই আই কানের করা নকশার সৌন্দর্য ধরে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ডিএমটিসিএল বলছে, সংসদ এলাকার ভেতর না প্রবেশ করলে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালসহ কয়েকটি ভবন ভাঙা পড়বে। এটা এড়ানোর জন্যই সংসদ এলাকায় প্রবেশ করা। আর সংসদ এলাকার যাতে সৌন্দর্য নষ্ট না হয়, সেভাবেই মেট্রোরেলের নকশা করা হবে। পাশাপাশি শব্দদূষণ এড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। সংসদ ভবন এলাকার ভেতর দিয়ে গেলে লুই কানের করা নকশা ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এমন দাবি করে পরিবেশবাদী নেতা ও স্থপতিরা এর বিরোধিতা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরেই। তাঁদের দাবি ছিল, মেট্রোরেলের লাইন সংসদ ভবনের পাশ ঘেঁষে নয়, বিজয় সরণি দিয়ে যেন নেওয়া হয়। জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেলটি চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশ দিয়ে বিজয় সরণি পথে গেলে সব সমস্যাই এড়ানো যেত। কিন্তু বিমানবাহিনীর অযৌক্তিক আপত্তির কারণে সরকার সংসদ ভবন এলাকা দিয়ে এর পথ ঠিক করে। তিনি জানান, ২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপিতে) মেট্রোরেল-৬-এর পথ হিসেবে বিজয় সরণির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। জাপানের সংস্থা জাইকার সমীক্ষাতেও এই পথটির কথা ছিল। জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিসভা কমিটি আগেই মেট্রোরেলের পথ ঠিক করেছে। সবচেয়ে কম ক্ষতি হয় সেটা ধরে নিয়েই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা-জাইকা দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। বাকিটা বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। প্রকল্পটির নির্বাহী সংস্থা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এটির কারিগরি নাম ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি)-৬। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে মেট্রোরেল প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। প্রকল্পের সময়সীমা ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তবে ২০১৯ সালের মধ্যে একাংশে যাত্রী পরিবহনের পরিকল্পনা নিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের নকশাসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নিপ্পন কোই এর নেতৃত্বে এনকেডিএমকে। ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, মেট্রোরেল প্রকল্পের অর্থের সমস্যা নেই। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে নকশা প্রণয়নসহ অন্য কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আগামী মাসে প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ নকশার প্রাথমিক রূপ পাওয়া যাবে। ১৬টি স্টেশনের নকশাও চূড়ান্ত। ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যায়ক্রমে ডিপো উন্নয়ন, ইঞ্জিন-কোচ কেনা, রেললাইন নির্মাণের দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা রয়েছে ডিএমটিসিএলের। মেট্রোরেল হওয়ার কথা মতিঝিল থেকে উত্তরা তৃতীয় পর্ব পর্যন্ত। এর দূরত্ব ২০.১ কিলোমিটার। পুরো লাইন ও স্টেশনগুলো হবে মাটির ওপরে, উড়াল পথে। মাটি থেকে এর উচ্চতা হবে ১৩ মিটার। ট্রেন সেট থাকবে ২৪টি। প্রতিটিতে ছয়টি বগি থাকবে। প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রিসভা কমিটি গত বছর ৮ মার্চ প্রস্তাবিত মেট্রোরেলের পথ অনুমোদন করে। এর ১৬টি স্টেশন হবে মতিঝিল, প্রেসক্লাব, টিএসসি, শাহবাগ, কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১, পল্লবী, উত্তরা (দক্ষিণ), উত্তরা (মধ্য), উত্তরা (উত্তর)। বর্তমানে মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভূতাত্ত্বিক জরিপ চলছে। সংসদ এলাকায় ৫৫ মিটার: পল্লবী থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত মেট্রোরেলের পুরো পথই বিদ্যমান সড়কের বিভাজকের ওপর দিয়ে যাবে। শুধু সংসদ ভবন ও ফার্মগেট এলাকাতেই এটি সড়ক বিভাজকের বাইরে থাকবে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসারে, এটি খামারবাড়ির সামনে দিয়ে ফার্মগেট পার্কের ভেতর দিয়ে যাবে। প্রকল্প সূত্র জানায়, সংসদ এলাকার ৫৫ মিটার ভেতর দিয়ে যাওয়ার মূল কারণ খামারবাড়ির বাঁক। এ ক্ষেত্রে সংসদ এলাকার খেজুরবাগানের তিন সারি গাছ কাটা পড়তে পারে। ফার্মগেট পার্কের মধ্যেও বড় কাছ কাটা পড়বে। উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে পল্লবী পর্যন্ত পথে এখনো স্থাপনা হয়নি। সেখানে আপাতত কোনো সমস্যা নেই। তবে নির্মাণকালীন সময় এর মাটির আচরণ কী হয় সেটা ভাবনায় রয়েছে কর্তৃপক্ষের। সূত্র জানায়, খামারবাড়ি বাঁচাতে মেট্রোরেলের লাইনে ইসলামিয়া চক্ষু হাসাপাতালের পেছন দিয়ে সড়ক ধরে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এতে চক্ষু হাসপাতালের তিনটি ব্লক ও ফার্মভিউ সুপার মার্কেটেরও একাংশ ভাঙা পড়ত। সংসদ এলাকা এবং ফার্মগেট পার্কের ভেতর দিয়ে গেলে খামারবাড়ি, চক্ষু হাসপাতাল ও মার্কেট সবই বাঁচবে। প্রকল্প সূত্র জানায়, ট্রেন লাইনে হঠাৎ বড় বাঁক নেওয়া যায় না। সংসদ এলাকার ৫৫ মিটার ভেতর দিয়ে গেলে যে বাঁক হবে তাতেও ট্রেনের গতি ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ গতি ধরা হয়েছে ১০০ কিলোমিটার। ডিপোর মাটি নরম: মেট্রোরেলের ডিপোর নির্ধারিত স্থানে রাজউক আগেই মাটি ভরাট করে রেখেছে। সমীক্ষায় এসেছে, ভরাট করা মাটির ৫ মিটারের মধ্যে ভূমিকম্প হলে তা সরে কিংবা দেবে যেতে পারে। এ ছাড়া ৫ মিটার থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত নরম কাদা মাটির স্তর রয়েছে, যা ভারী স্থাপনা তৈরির অন্তরায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দলও প্রস্তাবিত ডিপো এলাকা পরিদর্শন করে মাটি উন্নয়নে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। প্রকল্প সূত্র জানায়, ভারী স্থাপনা নির্মাণ হবে এমন ১৩ হেক্টর এলাকাজুড়ে গর্ত করে বালি দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই কাজকে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে মনে করছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ডিপো এলাকার মাটিতে সমস্যা আছে। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো এর উন্নয়ন করলেই চলবে। মেট্রোরেলের কর্মপরিকল্পনা: মেট্রোরেলের কাজ আটটি ভাগে (প্যাকেজ) ভাগ করা হয়েছে। ১ ও ২ নম্বর প্যাকেজের আওতায় ডিপো এলাকার মাটি উন্নয়ন ও স্থাপনা নির্মাণ হবে। এই দুটি প্যাকেজের মধ্যে মাটি উন্নয়নের দরপত্র আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে এবং ডিপোর স্থাপনা নির্মাণের দরপত্র অক্টোবরে আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রকল্পের ৩ থেকে ৬ নম্বর প্যাকেজের আওতায় মেট্রোরেলের পথ ও ১৬টি স্টেশন নির্মাণের কথা রয়েছে। এই প্যাকেজগুলোর প্রাথমিক দরপত্র আগামী বছর মে মাসে হবে। চূড়ান্ত দরপত্র সেপ্টেম্বরে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও অবকাঠামোর কাজ হবে ৭ নম্বর প্যাকেজের আওতায়। এটির প্রাথমিক দরপত্র ফেব্রুয়ারিতে আহ্বানের কথা রয়েছে। আর ট্রেনের ইঞ্জিন-কোচ কেনার প্রাথমিক দরপত্র জানুয়ারিতে এবং চূড়ান্ত দরপত্র আগামী জুলাইতে।
No comments:
Post a Comment