রছেন না। শ্রেণীকক্ষে নয় বরং কোচিং বা প্রাইভেটেই অনেক শিক্ষক এখন পাঠ্যবইয়ের শিক্ষাদান করে থাকেন। কাসে পড়ানোর ব্যাপারে তারা যতটা না মনোযোগী তার চেয়ে কোচিংয়ে পড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহ বেশি। প্রাইভেট কোচিংয়ে না পড়লে শিক্ষার্থীদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন এবং নানাভাবে হয়রানি করেন অনেক শিক্ষক। এরকম শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীরা সম্মান করবে কিভাবে এ প্রশ্ন অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের। এর সাথে রয়েছে দুর্নীতি, দলাদলি, কোন্দল এবং নানাবিধ অনিয়মের চিত্র সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ নেয়া হয় না বেসরকারি পর্যায়ে এমন কোনো স্কুল-কলেজ খুঁজে পাওয়া এখন দুষ্কর; বিশেষ করে হাইস্কুল এবং কলেজের ক্ষেত্রে। ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের সাথে এখন চলছে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি। রাজধানীর বিভিন্ন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে তিন লাখ টাকা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তির ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে ডোনেশনের নামে টাকা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানের শিক্ষাজীবন শুরু করছেন দুর্নীতির মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটিকে ঘিরে চলছে নানা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত। অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে এক শিক্ষক আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে রেখেছেন। ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে চলছে মামলা। ঘটছে বহিষ্কার-পাল্টাবহিষ্কারের ঘটনা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে পুলিশ এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কখনো ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে বহিষ্কার করে আরেকজন সে পদ দখল করছে। কখনো এক অধ্যক্ষ দখল করছেন আরেক অধ্যক্ষের চেয়ার। কখনো এক শিক্ষক তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছেন আরেক শিক্ষকের রুমে। আর উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ অভিযোগ অনেক পুরনো যে, সেখানে শিক্ষক নয় বরং ভোটার নিয়োগ করা হয়ে থাকে। যোগ্যতা এবং মেধা নয় বরং দলীয় বিবেচনাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। এসব কারণে শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ভক্তি সম্মান এবং মর্যাদা কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। এর পাশাপাশি ইদানীং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক ঘটছে যৌন নির্যাতনের ঘটনা। এ বিষয়ে অভিভাকরা জানান, মা-বাবা তাদের মেয়েদের বিষয়ে এখন শিক্ষকদের আর নিরাপদ মনে করছেন না। অভিভাবকরা জানান, ছোটরা খুবই অনুকরণপ্রিয়। মা-বাবার পাশাপাশি তাদের সন্তানরা প্রতিদিন দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের সাথে কাটায়। শিক্ষকদের কথাকে তারা গুরুত্ব দেয়। কোনো কোনো ছেলেমেয়ে এমনো রয়েছে যারা তাদের মা-বাবার কথার চেয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কথাকে বেশি গুরুত্ব বা মর্যাদা দেয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনুসরণ এবং অনুকরণ করে। অনেকে ছোটবেলায় শিক্ষকদের দেখে শিক্ষক হতে চায়। কিন্তু অনুকরণপ্রিয় তরুণ এবং শিক্ষার্থী সমাজের সামনে উত্তম চরিত্রের নীতি-আদর্শ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। উল্টো বরং শিক্ষকদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের রাস্তায় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হচ্ছে। অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে যোগ্য, আদর্শবান মেধাবীদের পরিবর্তে অসৎ, চরিত্রহীন, অযোগ্য এবং দলীয় লোকজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগসহ নানা ধরনের দুর্নীতি, দলাদলি, কোন্দল শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের অন্যতম একটি কারণ। এর কুফল নানাভাবে প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে আরো ঘটতে থাকবে। শিক্ষক এবং শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে মানুষের মনে যে বিশুদ্ধ পবিত্র নির্মল চিন্তার স্থানটা ছিল তা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। কাজী মো: আরসালান আসাদ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। তিনি এর আগে রাজধানীর নামকরা একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন। তিনি তার স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, আমরা ছিলাম শিক্ষকদের কাছে এক প্রকার জিম্মি। অনেক শিক্ষক আছেন যারা কোচিং-প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন ছাত্রছাত্রীদের। কাসে প্রকাশ্যে কোচিং-প্রাইভেটে পড়ার জন্য বলেন কোনো কোনো শিক্ষক। যারা কোচিং-প্রাইভেট পড়ে তাদের এক দৃষ্টিতে দেখেন আর যারা পড়ে না তাদের আরেক দৃষ্টিতে দেখেন। যারা শিক্ষকদের কাছে পড়ে না তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। কোনো কোনো শিক্ষক কাসে পড়ান একরকম আর কোচিংয়ে পড়ান আরেক রকম। এ ধরনের শিক্ষকদের প্রতি তো ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকে না। সরকারি চাকরিজীবী ফাহিম উদ্দিন আহমেদের মেয়ে রাজধানীর নামকরা একটি স্কুলে পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে। তিনি বলেন, নীতি-নৈতিকতা কী শিখাবেন শিক্ষকরা। তারাই তো বরং নানা ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের সাথে জড়িত। কোচিংয়ের কথা বলে চার হাজার ৮০০ টাকা নিয়েছেন কিন্তু চার থেকে পাঁচটা কাস মাত্র হয়েছে। আর কোনো কাস হয়নি। তা ছাড়া শিক্ষকরা কাসে না পড়িয়ে নিজেরা প্রাইভেট এবং কোচিং কপ্রণ বাসায়। বাসাকে তারা বানিয়েছেন বিকল্প স্কুল। শিক্ষকরা অনেক সময় কাসেই বলে দেন কোচিং-প্রাইভেট পড়ার জন্য। এসব শিক্ষকের কাছ থেকে কী নীতি-আদর্শ শিখবে শিক্ষার্থীরা? অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, এক সময় শিক্ষকদের বলা হতো মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু এখন অনেক শিক্ষক হলেন দুর্নীতির কারিগর। দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিনিময়ে অনেক অযোগ্য, অসৎ এবং চরিত্রহীন লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর কুফল প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রোকেয়া বেগম বলেন, অনেক সময় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এখন অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শাসন করতে পারেন না। অনেক সময় কোনো শিক্ষক রেগে একটা চড় দিলেও মা-বাবার কাছ থেকে অভিযোগ আসে। তার মতে আজকে যে পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে এ জন্য পরিবারও দায়ী। শুধু শিক্ষকদের দায়ী করা ঠিক হবে না। অভিভাবকরা তাদের দায়িত্ব কি ঠিকমতো পালন করছে? প্রাইভেট-কোচিং নিয়ে শিক্ষকদের দোষারোপ করা হয়। আমার কথা হলো মা-বাবা কোচিংয়ে দেন কেন? শিক্ষকরা তো জোর করে বাসা থেকে ধরে আনতে পারেন না। অনেক মায়েদের কোচিং-প্রাইভেট পড়ানোর রোগ রয়েছে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুগদা দিবা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক দেওয়ান বাকিউল্লাহ বলেন, পরিস্থিতি আজ যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে অনেক সময় শিক্ষকদের জন্যও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রছাত্রীদের শাসন করে পথে আনা। অনেক সময় শিক্ষকও হাল ছেড়ে দেন। শিক্ষকরাও নানা ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম কোচিং-প্রাইভেট এবং মেয়েঘটিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার বিষয় স্বীকার করে তিনি বলেন, এসব খবর যখন কানে আসে তখন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। রাজধানীর দনিয়া কলেজের উপাধ্যক্ষ একরামুল হক লিটন বলেন, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সামনে ভালো কিছু তুলে ধরতে পারছেন না এটা অনেকাংশেই সত্য। আদর্শ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সিলেবাস শেষ করা এবং পড়া গেলানোই এখন তাদের মূল কাজ। একজন আদর্শ শিক্ষকের কাজ কাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। আগে এটা ছিল কিন্তু এখন নেই। এখন বরং অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের বলে দেন ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্ররা কী করল বা না করল তা নিয়ে আমাদের কারোর মাথা ঘামাতে হবে না। তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় আগের মতো নৈতিক শিক্ষা নেই। আগে পাঠ্যবইয়ে চরিত্র গঠনের জন্য নীতিমূলক অনেক গল্প প্রবন্ধ ছিল। ডা: লুৎফর রহমানের মতো লেখকদের অনেক নৈতিক উপদেশমূলক লেখা কোমল মনে প্রভাব ফেলত। আমরা এসব লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিদায় হজের ভাষণ আমাদের মধ্যে চেতনা সৃষ্টি করত। এজাতীয় অনেক বিষয় আর আগের মতো নেই। যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষক ড. তবিবুর রহমানের মতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির শিকার আজকের শিক্ষাব্যবস্থা। আজকের সমাজের যে বাস্তবতা তা থেকে আলাদা কোনো কিছু নয় এ শিক্ষাব্যবস্থা। তার মতে সব শিক্ষক খারাপ তা নয়। ভালো শিক্ষক আছেন কিন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকীকরণের ফলে তারা এখন কোণঠাসা এবং অসহায় অবস্থায় নিপতিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আযাদ বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে গেছে রেজাল্টনির্ভর। বাণিজ্যনির্ভর। এখন ফলাফলই আসল। কী শিখল সেটা এখন আর আসল নয়। কাসে পড়াশোনায়ও অনেকের মনোযোগ নেই। কাসে আসতে হয় তাই আসে। পড়াশোনা তো হয় এখন কোচিং এবং প্রাইভেটে। প্রফেসর আজাদ বলেন, চারদিকে যেভাবে অনৈতিকতা ছড়িয়ে পড়ছে তার বিপরীতে তরুণ প্রজন্ম নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার মতো কোনো আদর্শ পাচ্ছেন না। একই বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে কিন্তু সে লেখাপড়া প্রকৃত লেখাপড়া হওয়া উচিত। অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে হলে আদর্শ চিন্তার বিকাশের ব্যবস্থা থাকা দরকার শিক্ষাব্যবস্থায়।
Headlines from most popular newspapers of Bangladesh. বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনামগুলো এক নজরে দেখে নিন।
Monday, December 1, 2014
দায় এড়াতে পারছেন না শিক্ষকসমাজ:নয়াদিগন্ত
রছেন না। শ্রেণীকক্ষে নয় বরং কোচিং বা প্রাইভেটেই অনেক শিক্ষক এখন পাঠ্যবইয়ের শিক্ষাদান করে থাকেন। কাসে পড়ানোর ব্যাপারে তারা যতটা না মনোযোগী তার চেয়ে কোচিংয়ে পড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহ বেশি। প্রাইভেট কোচিংয়ে না পড়লে শিক্ষার্থীদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন এবং নানাভাবে হয়রানি করেন অনেক শিক্ষক। এরকম শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীরা সম্মান করবে কিভাবে এ প্রশ্ন অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের। এর সাথে রয়েছে দুর্নীতি, দলাদলি, কোন্দল এবং নানাবিধ অনিয়মের চিত্র সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ নেয়া হয় না বেসরকারি পর্যায়ে এমন কোনো স্কুল-কলেজ খুঁজে পাওয়া এখন দুষ্কর; বিশেষ করে হাইস্কুল এবং কলেজের ক্ষেত্রে। ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের সাথে এখন চলছে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি। রাজধানীর বিভিন্ন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে তিন লাখ টাকা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তির ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে ডোনেশনের নামে টাকা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হচ্ছে। অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানের শিক্ষাজীবন শুরু করছেন দুর্নীতির মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটিকে ঘিরে চলছে নানা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত। অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে এক শিক্ষক আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে রেখেছেন। ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে চলছে মামলা। ঘটছে বহিষ্কার-পাল্টাবহিষ্কারের ঘটনা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে পুলিশ এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কখনো ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে বহিষ্কার করে আরেকজন সে পদ দখল করছে। কখনো এক অধ্যক্ষ দখল করছেন আরেক অধ্যক্ষের চেয়ার। কখনো এক শিক্ষক তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছেন আরেক শিক্ষকের রুমে। আর উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ অভিযোগ অনেক পুরনো যে, সেখানে শিক্ষক নয় বরং ভোটার নিয়োগ করা হয়ে থাকে। যোগ্যতা এবং মেধা নয় বরং দলীয় বিবেচনাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। এসব কারণে শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ভক্তি সম্মান এবং মর্যাদা কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। এর পাশাপাশি ইদানীং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক ঘটছে যৌন নির্যাতনের ঘটনা। এ বিষয়ে অভিভাকরা জানান, মা-বাবা তাদের মেয়েদের বিষয়ে এখন শিক্ষকদের আর নিরাপদ মনে করছেন না। অভিভাবকরা জানান, ছোটরা খুবই অনুকরণপ্রিয়। মা-বাবার পাশাপাশি তাদের সন্তানরা প্রতিদিন দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের সাথে কাটায়। শিক্ষকদের কথাকে তারা গুরুত্ব দেয়। কোনো কোনো ছেলেমেয়ে এমনো রয়েছে যারা তাদের মা-বাবার কথার চেয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কথাকে বেশি গুরুত্ব বা মর্যাদা দেয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনুসরণ এবং অনুকরণ করে। অনেকে ছোটবেলায় শিক্ষকদের দেখে শিক্ষক হতে চায়। কিন্তু অনুকরণপ্রিয় তরুণ এবং শিক্ষার্থী সমাজের সামনে উত্তম চরিত্রের নীতি-আদর্শ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। উল্টো বরং শিক্ষকদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের রাস্তায় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হচ্ছে। অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে যোগ্য, আদর্শবান মেধাবীদের পরিবর্তে অসৎ, চরিত্রহীন, অযোগ্য এবং দলীয় লোকজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগসহ নানা ধরনের দুর্নীতি, দলাদলি, কোন্দল শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের অন্যতম একটি কারণ। এর কুফল নানাভাবে প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে আরো ঘটতে থাকবে। শিক্ষক এবং শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে মানুষের মনে যে বিশুদ্ধ পবিত্র নির্মল চিন্তার স্থানটা ছিল তা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। কাজী মো: আরসালান আসাদ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। তিনি এর আগে রাজধানীর নামকরা একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন। তিনি তার স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, আমরা ছিলাম শিক্ষকদের কাছে এক প্রকার জিম্মি। অনেক শিক্ষক আছেন যারা কোচিং-প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন ছাত্রছাত্রীদের। কাসে প্রকাশ্যে কোচিং-প্রাইভেটে পড়ার জন্য বলেন কোনো কোনো শিক্ষক। যারা কোচিং-প্রাইভেট পড়ে তাদের এক দৃষ্টিতে দেখেন আর যারা পড়ে না তাদের আরেক দৃষ্টিতে দেখেন। যারা শিক্ষকদের কাছে পড়ে না তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। কোনো কোনো শিক্ষক কাসে পড়ান একরকম আর কোচিংয়ে পড়ান আরেক রকম। এ ধরনের শিক্ষকদের প্রতি তো ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকে না। সরকারি চাকরিজীবী ফাহিম উদ্দিন আহমেদের মেয়ে রাজধানীর নামকরা একটি স্কুলে পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে। তিনি বলেন, নীতি-নৈতিকতা কী শিখাবেন শিক্ষকরা। তারাই তো বরং নানা ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের সাথে জড়িত। কোচিংয়ের কথা বলে চার হাজার ৮০০ টাকা নিয়েছেন কিন্তু চার থেকে পাঁচটা কাস মাত্র হয়েছে। আর কোনো কাস হয়নি। তা ছাড়া শিক্ষকরা কাসে না পড়িয়ে নিজেরা প্রাইভেট এবং কোচিং কপ্রণ বাসায়। বাসাকে তারা বানিয়েছেন বিকল্প স্কুল। শিক্ষকরা অনেক সময় কাসেই বলে দেন কোচিং-প্রাইভেট পড়ার জন্য। এসব শিক্ষকের কাছ থেকে কী নীতি-আদর্শ শিখবে শিক্ষার্থীরা? অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, এক সময় শিক্ষকদের বলা হতো মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু এখন অনেক শিক্ষক হলেন দুর্নীতির কারিগর। দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিনিময়ে অনেক অযোগ্য, অসৎ এবং চরিত্রহীন লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর কুফল প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রোকেয়া বেগম বলেন, অনেক সময় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এখন অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শাসন করতে পারেন না। অনেক সময় কোনো শিক্ষক রেগে একটা চড় দিলেও মা-বাবার কাছ থেকে অভিযোগ আসে। তার মতে আজকে যে পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে এ জন্য পরিবারও দায়ী। শুধু শিক্ষকদের দায়ী করা ঠিক হবে না। অভিভাবকরা তাদের দায়িত্ব কি ঠিকমতো পালন করছে? প্রাইভেট-কোচিং নিয়ে শিক্ষকদের দোষারোপ করা হয়। আমার কথা হলো মা-বাবা কোচিংয়ে দেন কেন? শিক্ষকরা তো জোর করে বাসা থেকে ধরে আনতে পারেন না। অনেক মায়েদের কোচিং-প্রাইভেট পড়ানোর রোগ রয়েছে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুগদা দিবা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক দেওয়ান বাকিউল্লাহ বলেন, পরিস্থিতি আজ যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে অনেক সময় শিক্ষকদের জন্যও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রছাত্রীদের শাসন করে পথে আনা। অনেক সময় শিক্ষকও হাল ছেড়ে দেন। শিক্ষকরাও নানা ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম কোচিং-প্রাইভেট এবং মেয়েঘটিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার বিষয় স্বীকার করে তিনি বলেন, এসব খবর যখন কানে আসে তখন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। রাজধানীর দনিয়া কলেজের উপাধ্যক্ষ একরামুল হক লিটন বলেন, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সামনে ভালো কিছু তুলে ধরতে পারছেন না এটা অনেকাংশেই সত্য। আদর্শ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সিলেবাস শেষ করা এবং পড়া গেলানোই এখন তাদের মূল কাজ। একজন আদর্শ শিক্ষকের কাজ কাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। আগে এটা ছিল কিন্তু এখন নেই। এখন বরং অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের বলে দেন ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্ররা কী করল বা না করল তা নিয়ে আমাদের কারোর মাথা ঘামাতে হবে না। তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় আগের মতো নৈতিক শিক্ষা নেই। আগে পাঠ্যবইয়ে চরিত্র গঠনের জন্য নীতিমূলক অনেক গল্প প্রবন্ধ ছিল। ডা: লুৎফর রহমানের মতো লেখকদের অনেক নৈতিক উপদেশমূলক লেখা কোমল মনে প্রভাব ফেলত। আমরা এসব লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিদায় হজের ভাষণ আমাদের মধ্যে চেতনা সৃষ্টি করত। এজাতীয় অনেক বিষয় আর আগের মতো নেই। যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষক ড. তবিবুর রহমানের মতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির শিকার আজকের শিক্ষাব্যবস্থা। আজকের সমাজের যে বাস্তবতা তা থেকে আলাদা কোনো কিছু নয় এ শিক্ষাব্যবস্থা। তার মতে সব শিক্ষক খারাপ তা নয়। ভালো শিক্ষক আছেন কিন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকীকরণের ফলে তারা এখন কোণঠাসা এবং অসহায় অবস্থায় নিপতিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আযাদ বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে গেছে রেজাল্টনির্ভর। বাণিজ্যনির্ভর। এখন ফলাফলই আসল। কী শিখল সেটা এখন আর আসল নয়। কাসে পড়াশোনায়ও অনেকের মনোযোগ নেই। কাসে আসতে হয় তাই আসে। পড়াশোনা তো হয় এখন কোচিং এবং প্রাইভেটে। প্রফেসর আজাদ বলেন, চারদিকে যেভাবে অনৈতিকতা ছড়িয়ে পড়ছে তার বিপরীতে তরুণ প্রজন্ম নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার মতো কোনো আদর্শ পাচ্ছেন না। একই বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে কিন্তু সে লেখাপড়া প্রকৃত লেখাপড়া হওয়া উচিত। অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে হলে আদর্শ চিন্তার বিকাশের ব্যবস্থা থাকা দরকার শিক্ষাব্যবস্থায়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment