Wednesday, December 31, 2014

অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরেনি:কালের কন্ঠ

অর্থনীতিতে তেমন কোনো পতন বা বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেনি সদ্য শেষ হওয়া বছরে। তাই ২০১৪ সালকে স্থিতিশীল অর্থনীতির বছর বলা যায়। তবে নতুন সরকার গঠনের বছরে অর্থনীতিতে গ
তিসঞ্চারের যে ধারা অতীতে ছিল, এবার তা হয়নি। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার অভাব দেখা গেছে বছরজুড়েই। মধ্যম আয়ের দেশের পথে এগোনোর মতো ভাব-গতি কিছুই মেলেনি গেল বছর। অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও বলার মতো উল্লম্ফন ছিল না। সব মিলিয়ে স্থিতিশীল; কিন্তু গতিহীন অর্থনীতি পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে দুর্বল গতির অর্থনীতির ধকল ব্যবসায়ীদের ওপর দিয়ে গেলেও ভোক্তাদের একটি ভালো বছর কেটেছে। সহনীয় মূল্যে জিনিসপত্র কেনার সুযোগ মিলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দরপতনও সহনীয় মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নির্বাচনের আগে বছরখানেক ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ থেকে হাত গুটিয়ে রাখেন। ফলে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় বেশ কম হয়েছে। কিন্তু পরের বছরে গতিশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিনিয়োগের ব্যাপকতায় সেই ক্ষতি পুষিয়ে যেত। গেল বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে ব্যাপক নাশকতায় জনজীবন অচল হয়ে পড়েছিল। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল ব্যবসা-বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, রেমিট্যান্স, রপ্তানিসহ অর্থনীতির সব খাতেই। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে তা কিছুটা লাঘব হয়েছে। তবে গুমোট রাজনৈতিক পরিস্থিতি দৃশ্যত স্থিতিশীল মনে হলেও ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে স্বস্তি ফেরেনি তার প্রতিফলন রয়েছে বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যে। সেখানে নিবন্ধনের প্রস্তাব কিছুটা বেড়েছে, তবে প্রকৃত বিনিয়োগ সে মাত্রায় দৃশ্যমান নয় দেশি-বিদেশি কোনো ক্ষেত্রেই। এ পরিস্থিতিতে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেরই। চলতি অর্থবছরে ৭.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে মোট দেশজ উৎপাদন (গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্টস- জিডিপি) ৩৪-৩৫ শতাংশ হারে বিনিয়োগ দরকার হবে। অথচ বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশের মতো। অর্থবছরের অর্ধেক এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। বাকি সময়ে বিনিয়োগ ওই স্তরে পৌঁছবে এমন আশা কেউ করছে না। তাই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা এবারও অধরা থেকে যাওয়ার আশঙ্কাই প্রকট। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬.২ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৪ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে চলতি অর্থবছরে গত চার অর্থবছরের সমান গড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাবে কি না সে বিষয়ে সংশয় আছে। তবে শান্তি ফিরে এলে অর্থনীতির সূচকগুলোতে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক আরো বলেছে, চলতি অর্থবছরে (২০১৩-১৪) ৭.২০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা হয়তো অর্জন করা যাবে না। তবে চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরের চেয়ে কম হবে না। বছরের শেষ দিকে 'সুখবর' হিসেবে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের খবর জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বছরই সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ গড়ে বাংলাদেশ, যা দিয়ে প্রায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এখন প্রতি মাসে আমদানির গড় ব্যয় ৩৫০ কোটি ডলার বা ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। বিশাল এই রিজার্ভের পেছনেও অস্বস্তি আছে। উদীয়মান ও সম্প্রসারণশীল অর্থনীতিতে বড় আকারে রিজার্ভ গড়ে ওঠে না। মূলত শিল্প খাতে বিনিয়োগ কম হওয়ায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেছে, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও সে হারে বাড়েনি। তাই রপ্তানি, রেমিট্যান্স আর বিদেশি ঋণ-অনুদানে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে বাংলাদেশ, উৎপাদনমুখী শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় সেখান থেকে ব্যয়ও কম হয়েছে। ফলে রিজার্ভ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হাতে রাখা যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য নিরাপদ। ন্যূনতম এ রিজার্ভ রাখতেই একসময় হিমশিম খেতে হতো বাংলাদেশ ব্যাংককে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে কয়েক বছর আগেই। ফলে ডলারের সঙ্গে মুদ্রার মূল্যমানের অবনতিতে অনেক দেশ নাকাল হলেও দাপুটে বৈশ্বিক মুদ্রাটির সঙ্গে বিনিময়মূল্য স্থির রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশের টাকা। বিদায়ী বছর রাজনীতিতে তেমন কোনো সহিংসতা না থাকায় বিনিয়োগে আগ্রহ ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা বাড়ে। তবে চূড়ান্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পিছু হটেন তাঁরা। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য মতে, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শতভাগ বিদেশি অথবা যৌথ উদ্যোগে ৮১টি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার ৩৮৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত হয়। তবে এসব প্রস্তাবের বিপক্ষে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র হাজার কোটি টাকার মতো। দেশের অর্থনীতির প্রাণ হলো ব্যাংক বা আর্থিক খাত। বিনিয়োগকারীদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থের জোগান আসে এ খাত থেকে। কিন্তু একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারিতে সরকারি-বেসরকারি বেশির ভাগ ব্যাংকের অবস্থাই এখন নাজুক। নানা নিয়মের বেড়াজাল আর উচ্চ সুদহারের কারণে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক থেকে দূরে থাকছেন। তাঁরা বরং দেশ ছেড়ে বিদেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মতে, ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন। আর দেশের ব্যাংকগুলো বলছে, 'যোগ্য' ঋণগ্রহীতা না পাওয়ায় তাদের ভল্টে অলস পড়ে আছে ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের নেওয়া ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ খেলাপি হয়ে আছে। সব মিলিয়ে আগের বছরগুলোর মতো বিদায়ী বছরেও দেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট কাটেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলধনের ঘাটতি মেটাতে গত বছর সরকার চার হাজার ১০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এসে সরকারি চার ব্যাংক এক হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ২৯১ কোটি টাকা, যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ১৬ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা বেশি। খেলাপি ঋণ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে লিখিত জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকিং খাতের জালিয়াতি ও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা খেলাপি বাড়ার কারণ। সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১১.৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতিও ভালো নয়। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৩৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা আয়ের কথা থাকলেও হয়েছে ৩৭ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। রাজস্ব আয় কমে গেলে শেষ পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) কাটছাঁট করে ব্যয় কমাতে বাধ্য হয় সরকার। এবারও তেমনটি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদায়ী বছরে রপ্তানি আয়ে স্থিতিশীলতা ছিল না। প্রথম দিকে কোনো কোনো মাসে আয় বাড়লেও বছরের শেষ দিকে আয় বেশ কমেছে। গত অক্টোবরে রপ্তানি আয় ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম; যদিও নভেম্বরে আবারও কিছুটা ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। সব মিলিয়ে বছর শেষে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির দেখা মিললেও তা সমমানের অন্য দেশের তুলনায় বেশ কম। বিশেষ করে, ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক বিক্রির পরিমাণ প্রধান প্রতিযোগী ভারত, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার তুলনায় অনেক কম। রানা প্লাজা ধসে পড়া, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দুনিয়ার ভোক্তাদের কাছে বাংলাদেশের পোশাক খাত সুনাম সংকটে ভুগছে। অবশ্য ঢাকায় অ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে সেই সংকট কাটাতে চেষ্টা করছেন রপ্তানিকারকরা। রপ্তানি আয়ের মতোই কখনো ঊর্ধ্বমুখী আবার কখনো নিম্নমুখী ছিল শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির চিত্রও। জুলাই মাসে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে ৪৯ শতাংশ। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ২৫ কোটি পাঁচ লাখ ডলারের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করেন শিল্পপতিরা। গত জুলাই মাসে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে পোশাক খাতের কাঁচামাল সুতা আমদানি হয় ১৬ কোটি আট লাখ ডলারের। এবার একই সময়ে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ কোটি ডলারে। একইভাবে কমেছে অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও। তবে পরের মাসগুলোতে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে কিছুটা গতি ফেরে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ২.২০ শতাংশ। বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এ ধরনের অর্থনীতিতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ থাকে বিপুল। কর্মসংস্থান হয়, আয় বাড়ে, বাড়ে মৌলিক ও ভোগ ব্যয়। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটি ছিল গত কয়েক বছর। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। পড়ন্ত মূল্যস্ফীতির হার। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের তথ্যকে ভিত্তি ধরে ২০১৪ সালের শুরুতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৩৫ শতাংশ। জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৬.৯৭ শতাংশ। এরপর অক্টোবরে ৬.০৬ শতাংশ এবং নভেম্বর শেষে তা আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৬.২১ শতাংশে। এতে ভোক্তা পর্যায়ে স্বস্তি ফিরলেও কৃষি ও শিল্প উৎপাদন পর্যায়ে উদ্যম ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা থাকে, যার প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। প্রবৃদ্ধির প্রধান লক্ষ্য আয় বাড়ানো। দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিতে বর্ধিত আয়ের সহযাত্রী বাড়তি মূল্যস্ফীতি।    

No comments:

Post a Comment