Sunday, January 11, 2015

৪৩ বছরের লাঞ্ছনার কান্না মঞ্চজুড়ে:কালের কন্ঠ

সারি সারি সাজানো বড় বড় ডিজিটাল বিলবোর্ড। তাতে ফুটে রয়েছে একেকজনের ছবি। একটা ছবির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন মা ও মেয়ে। মেয়েটি বললেন, ‘মা, দেখো, তোমার ছবি। বয়সের ভারে বুজ
ে আসা চোখ মেলে মা তাকালেন ছবিটির দিকে। নিজের চেহারার সামনাসামনি হয়ে অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন। এরপর একসময় আঁচলে চোখ মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মায়ের সঙ্গে কাঁদলেন তরুণী মেয়েটিও। ঘটনাটি গতকাল ১০ জানুয়ারি, শনিবার সকালে ঢাকার বসুন্ধরা কনভেনশন সিটির পুষ্পগুচ্ছ হলের। সেখানে চলছিল দৈনিক কালের কণ্ঠের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উৎসব-অনুষ্ঠানমালা। একটি পর্বের আয়োজন বিকেলে; নাম- ‘বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা’। তাঁদেরই ছবি শোভা পাচ্ছিল বিলবোর্ডে। আর এরই একটির সামনে দাঁড়িয়ে যিনি চোখের পানিতে হল ভেজালেন, তিনি কুষ্টিয়ার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা দুলজান নেছা। অনুষ্ঠান শুরুর অনেক আগে নিজের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে এই বীরাঙ্গনা চোখের জলে ভাসলেন আনন্দে না দুঃখে, বোঝা গেল না। শুধু বোঝা গেল, স্বাধীনতাযুদ্ধে হানাদার হায়েনাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে, এরপর ৪৩ বছরের অবহেলিত জীবন কাটিয়ে অবশেষে সামান্য সম্মাননা নিতে এসে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি বীরাঙ্গনা। ৪৩ বছরের জমে থাকা কষ্টই যেন একটু আনন্দের তাপে গলে বেরিয়ে আসে চোখের পানি হয়ে। সম্মাননা পর্ব শুরু হওয়ার পর ১৬ জন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা আর তাঁদের স্বজনদের চোখে আনন্দ-বেদনার অশ্রু নামে বাঁধভাঙা ঢলের মতো। গতকাল বিকেল পৌনে ৪টার দিকে সম্মাননা অনুষ্ঠানের শুরুতেই মঞ্চে এলেন কিশোরগঞ্জের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা রাসমণি চক্রবর্তী। বয়স ষাট বছরের বেশি। কালের কণ্ঠের সম্মাননা পেয়ে তিনি আপ্লুত, বাকরুদ্ধ। কোনো কথা বলতে পারলেন না। দীর্ঘদিনের চাপা বেদনায়, রুদ্ধশ্বাসে একসময় ফুঁপিয়ে উঠলেন। এরপর ভেঙে পড়লেন আকুল কান্নায়। হলভর্তি মানুষ স্তব্ধ। পিনপতন নীরবতা। সবার চোখে অশ্রু। মন্ত্রীরাও চোখ মুছলেন। আবেগঘন এ অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠলেন গাজীপুরের প্রয়াত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা মোমতাজ বেগমের দুই মেয়ে নিলুফা ইয়াসমিন  ও জাকিয়া সুলতানা। সদ্য প্রয়াত মায়ের পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করতে এসে মঞ্চে উঠে কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই বোন। কেঁদে কেঁদে জড়িয়ে ধরেন মঞ্চে উপস্থিত কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও ভাস্কর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে। সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টাও যেন বৃথা যায়। অনুষ্ঠানজুড়ে আবারও নামে পিনপতন নীরবতা। সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে গিয়ে বারবার বাকরুদ্ধ হয়ে আড়ালে গিয়ে চোখ মোছেন সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। এভাবেই যেন লাখো মুক্তিযোদ্ধার হৃদয়ের সব দুঃখকষ্ট-বেদনা চোখের জলে ঢেলে দিয়েছেন সম্মাননাপ্রাপ্ত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধারা। দৈনিক কালের কণ্ঠের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এই ‘বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা’ অনুষ্ঠান। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটির পুষ্পগুচ্ছ হলে গতকাল শনিবার বিকেলে ছিল এ বিশেষ আয়োজন। ২০১৩ সালের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে যে ১৬ জন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার জীবন ও সংগ্রামের কাহিনী ছাপা হয় কালের কণ্ঠে, তাঁদেরই গতকাল পত্রিকাটির ষষ্ঠ জন্মদিনে উত্তরীয় পরিয়ে, ক্রেস্ট ও নগদ এক লাখ টাকা করে হাতে দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। সম্মাননা পেয়ে অভিভূত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধারা। অভিভূত অভ্যাগত অতিথিরাও। অনুভূতি জানাতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেন সম্মাননাপ্রাপ্তরা। রাহেলা বেগম শুধু বলেছেন, ‘সারা জীবন লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সয়েছি। অপমানিত বোধ করেছি। রাষ্ট্রও স্বীকৃতি দেয়নি। কালের কণ্ঠ যে সম্মান দিল- তা পাব, কখনো ভাবিনি।’ অনুষ্ঠানের শুরুতে কালের কণ্ঠ সম্পাদক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন সবাইকে স্বাগত জানান। গোটা অনুষ্ঠান তিনি সঞ্চালনাও করেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘কালের কণ্ঠ শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে। আমাদের চেতনায় দেশপ্রেম, রক্তের শিরায় শিরায় মুক্তিযুদ্ধ, প্রেরণার শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধই ছিল আমাদের সুসময় এবং চরম দুঃসময়ও। ওই একবারই আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম, কিছু রাজাকার ছাড়া। আর তখনই ৩০ লাখ স্বজন হারিয়েছি আমরা। ওই সময় পাকিস্তানিরা যে নির্যাতন চালিয়েছে তার ইতিহাস পৃথিবীতে আর নেই। যে নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁদের চেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা, স্মরণীয় মুক্তিযোদ্ধা আর নেই। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই বীরকন্যাদের আমরা সম্মান দিতে পারিনি, পুনর্বাসন করতে পারিনি। কালের কণ্ঠ শুরু থেকেই তাঁদের সম্মান জানিয়ে আসছে।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন এর আগে কালের কণ্ঠের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রণাঙ্গনের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ এবং দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মায়েদের ‘কেমন আছ মা’ বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ক্রেস্ট তুলে দেন ভাস্কর ও মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। সম্মাননার অর্থ নগদ এক লাখ টাকা করে তুলে দেন অতিথিদ্বয়। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কালের কণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক অমিত হাবিব, নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল, প্রকাশক ময়নাল হোসেন চৌধুরী প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সম্মাননা জানানো হয় কিশোরগঞ্জের মিটামইন সদরের সরকারহাটির রাসমণি চক্রবর্তী, বরিশাল গৌরনদীর বাটাজোড় ইউনিয়নের বাংকুরাত (চন্দ্রহার) গ্রামের নূরজাহান বেগম, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামের মোমতাজ বেগম (প্রয়াত), কুষ্টিয়ার কুমারখালীর দুলজান নেছা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের আবদুল্লাপুর গ্রামের জোহরা বেগম, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামের লাইলি বেগম, সিরাজগঞ্জের রাহেলা বেগম, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের নুরজাহান বেগম, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের দীপ্তি রানী দে, ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের শশীগঞ্জ চাঁদপুর গ্রামের মালেকা বেগম, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের কালেগ্রামের খুকি বেগম, পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শাঁখারীকাঠি গ্রামের লক্ষ্মীরানী রায় ও গোপালগঞ্জের রওশন আরাকে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামের প্রয়াত মোমতাজ বেগমের পক্ষে দুই মেয়ে নীলুফা ইয়াসমিন ও জাকিয়া সুলতানা এবং গোপালগঞ্জের রওশন আরার অনুপস্থিতিতে তাঁর পক্ষে মেয়ে রহিমন বেগম সম্মাননা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া সম্মাননা দেওয়া হয় গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলা সদরের উত্তরপাড়ার রাজকুমারী ফুলমতি রানী রবিদাস, সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের মনতইল গ্রামের এসনু বেগম ও খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার থলিপাড়ার চাইন্দাউ মারমাকে। তবে গতকাল তাঁরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। কালের কণ্ঠ সম্পাদক ঘোষণা করেন, তিনি নিজে গিয়ে তাঁদের হাতে সম্মাননা স্মারক ও অর্থ তুলে দেবেন। অনুষ্ঠানে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, ‘আজ বীরাঙ্গনাদের কান্না দেখতে পেলাম। এই কান্না আমারও কান্না। এই কান্না একসময় পলায়নপর করেছিল আমাকে, এখন গর্ববোধ করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি কোনো দল করি না, তার পরও বলছি, শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। বিচারটা যেন শেষ করতে পারে। আমরা আর এ দেশে রাজাকার দেখতে চাই না, এ দেশের মাটিতে রাজাকারের কবর দেখতে চাই না। স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সর্বক্ষণ প্রহরারত থাকব।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বীরাঙ্গনাদের সম্মাননা জানানোর জন্য কালের কণ্ঠের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘বীরাঙ্গনাদের এত দিন শ্রদ্ধা জানাতে পারিনি; তার দায় অবনত মস্তকে স্বীকার করছি। কালের কণ্ঠ আজ তাঁদের সম্মান জানিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এ মহৎ উদ্যোগের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি কালের কণ্ঠের কাছে কৃতজ্ঞ।’ সরকারও বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তিনি জানান। কালের কণ্ঠের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে এসে ‘বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এ সময় ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘কালের কণ্ঠ সমাজের তৃতীয় নয়ন বা আয়না হিসেবে কাজ করছে। সরকার ও বিরোধী দলের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার বাইরে বীরাঙ্গনাদের সম্মান জানানোরও আয়োজন করল কালের কণ্ঠ। এ জন্য আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে দলের পক্ষ থেকে আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি কালের কণ্ঠের প্রতি।’ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এমন একটি অনুষ্ঠানে এসে অভিভূত হয়েছি। কালের কণ্ঠ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। যাঁদের আমরা ভুলে যাচ্ছিলাম তাঁদের সামনে তুলে এনেছে কালের কণ্ঠ।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের সম্মান দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেউ তাঁদের খোঁজ রাখতেন না। শেখ হাসিনা আবার তাঁদের খোঁজ নিচ্ছেন। তাঁদের সম্মান দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।’ এ অনুষ্ঠানেই কালের কণ্ঠের প্রয়াত সাংবাদিক কবি আপন মাহমুদের বাবা মো. আবদুর রবের হাতে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়।

No comments:

Post a Comment