সমাবেশের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে টানা অবরোধ কর্মসূচি চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রায় তিন দিন ধরে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন
, 'আমাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি বন্ধ করতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। আমি বলতে চাই, সমাবেশের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলবে।' দেশবাসীকে গণতন্ত্রের সংগ্রাম-কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'সরকার হামলা-মামলা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে সমাবেশ করার। তাই সমাবেশ করতে দিতে হবে।' তিনি বলেন, এ সরকার অবৈধ। সরকারের সব কার্যক্রম অবৈধ। এদের বিরুদ্ধে দেশবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তাই দেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন প্রয়োজন। আবারও নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, নির্বাচন দিয়ে প্রমাণ করুন জনগণ কাদের সঙ্গে আছে। বাইরে বের হতে ব্যর্থ হয়ে গতকাল সোমবার বিকেলে গুলশান কার্যালয়ের ভেতরে প্রধান গেটের কাছে বিএনপি চেয়ারপারসন এ ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণার বরাত দিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ পরে সাংবাদিকদের জানান, সারা দেশে সড়কপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত চলবে। গতকালের কর্মসূচি পালন করার সময় যারা নিহত হয়েছে, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে ওই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি প্রায় ২৬ মিনিট বক্তব্য দেন। সমাবেশের ওপর ১৪৪ ধারা জারির সমালোচনা করে খালেদা বলেন, 'এত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেও আমাদের কর্মসূচি তারা বন্ধ করতে পারেনি। জনগণ, আমাদের দল ও ২০ দলীয় নেতা-কর্মীরা শত বাধা উপেক্ষা করে কর্মসূচি পালন করেছে।' এ জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিনন্দন জানান তিনি। ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের বছরপূর্তির দিনটিকে বিএনপি গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গতকাল সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিল করে। ক্ষমতাসীন দলসহ আইন-শঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হামলা চালিয়ে তাদের এ কর্মসূচি পালনে বাধা দিয়েছে- অভিযোগ করে মাঠের নেতা-কর্মীদের ওপর এই হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান খালেদা জিয়া। শনিবার রাত ৮টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন, নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রুহুল কবীর রিজভী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে দেখার জন্য খালেদা জিয়া নয়াপল্টনের দিকে রওনা হতে চাইলে গুলশান কার্যালয়ের গেটেই তাঁকে আটকে দেয় পুলিশ। এর পর থেকে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। গতকাল বিকেল ৪টার সময় তিনি নয়াপল্টনের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁকে বের হতে দেয়নি। প্রধান গেটে গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ তালা ঝুলিয়ে দেয়। খালেদা জিয়া কার্যালয়ের দোতলা থেকে নেমে গেটের কাছে গিয়ে নিজের নিশান প্যাট্রল গাড়িতে ওঠেন। তাঁর হাতে ছিল কালো পতাকা। তিনি গাড়িতে প্রায় আধা ঘণ্টা বসে থাকেন। এ সময় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান, মহিলা দলের সভানেত্রী নূরে আরা সাফা, সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, সাবেক সংসদ সদস্য রেহানা আখতার রানু, নীলুফার চৌধুরী মনি, রাশেদা বেগম হীরা, সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, সুলতানা আহমেদ, ফরিদা ইয়াসমীন প্রমুখ সেখানে ছিলেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে আগে থেকেই ছিলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান। বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষে সাবেক পুলিশ মহাপরির্দশক আবদুল কাউয়ুম ও বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা চেয়ারপারসনকে বাইরে যেতে দিতে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ জানান। কিন্তু তাঁরা গেটের তালা খুলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে শিমুল বিশ্বাস বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ নন। সরকার যে মিথ্যাচার করছে তা খালেদা জিয়াকে বের হতে না দেওয়ার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো। তালা না খোলায় মহিলা দলের নেত্রী নুরে আরা সাফা, শিরিন সুলতানা, রেহানা আখতার রানু, নিলোফার চৌধুরী মনি, আশরাফী পাপিয়া, রাশেদা বেগম হীরা, সুলতানা আহমেদ, খালেদা ইয়াসমিনসহ কয়েকজন গেটে লাথি মেরে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় দুই দফা তাঁদের ওপর পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে একটি টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সর্বত্র দলীয়করণ, স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিরোধী দলের কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়ার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। সরকার দেশটাকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, 'আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ক্ষমতাসীনরা মিছিল-মিটিং করছে। এটা কি ধরনের গণতন্ত্র?' তিনি বলেন, 'কেন আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, কার্যালয়ের সামনে কেন ইট-বালুভর্তি ট্রাক, আমার কার্যালয়ের প্রধান গেটে কেন তালা লাগানো হয়েছে? কারণ আমি কর্মসূচিতে গেলে মানুষের স্রোত নামবে। এই অবৈধ সরকার জনগণকে ভয় পায়।' তিনি বলেন, এই সরকারের পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। দেশবাসী সরকারকে আর দেখতে চায় না। তিনি প্রশ্ন করেন, আমি যদি অবরুদ্ধ না থাকি তাহলে কেন আমার সঙ্গে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেখা করতে দেওয়া হয় না। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী সাহেবকে কেন কার্যালয়ে আসতে দেওয়া হলো না? তিনি বলেন, সারা দেশে অনেকের রক্ত ঝরিয়েছে সরকার ও তার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু এভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না। রক্ত দিয়ে এই সরকারকে বিদায় করে দেশে আইনের সুশাসন ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হবে। পিপার স্প্রে নিক্ষেপের সমালোচনা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আপনারা (পুলিশ বাহিনী) এভাবে গ্যাস কেন মারছেন? আমি কথা বলছি দেখতে পাচ্ছেন না? পিপার স্প্রে নিক্ষেপ বন্ধ করুন। পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, কী এমন ঘটনা ঘটেছে যে, পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করতে হবে? আমাদের সঙ্গে আপনাদের (পুলিশ বাহিনী) কোনো বিরোধ নেই। একটি বিশেষ জেলার ও ছাত্রলীগের লোকজন এই বাহিনীর ইমেজ নষ্ট করছে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সম্প্রচারনীতির কথা তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, শুনেছি ইটিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগেও কয়েকটি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করেছে এই অবৈধ সরকার। তিনি বলেন, বিরোধী দলের সংবাদ যাতে না যায় সে জন্য গণমাধ্যমের ওপরও সরকার হস্তক্ষেপ করছে। কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচিতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর জাতীয় প্রেসক্লাবে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলার অপচেষ্টারও নিন্দা জানান খালেদা জিয়া। অবরুদ্ধ অবস্থায় গুলশানের কার্যালয়ে তিনি কেমন আছেন জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেন, কষ্ট করে এখানে আছি। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার পরও থাকতে হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment