Tuesday, January 20, 2015

অবরোধমুক্ত খালেদা অবরুদ্ধ দেশ:কালের কন্ঠ

অবরোধের দুর্ভোগ আর কাটল না দেশবাসীর। ১৫ দিন আটকে থাকার পর গতকাল সোমবার মুক্তি মিললেও ঘোষিত কর্মসূচিতে অনড় মনোভাবের কারণে নিজ কার্যালয় থেকে বের হননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও স্বামী জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতেও যাননি তিনি। এর পরও দেশবাসীর মনে প্রত্যাশা জেগেছিল খালেদা জিয়া নিজে যেহেতু অবরোধমুক্ত হয়েছেন, সেহেতু তিনি জনগণকেও ভোগান্তির অবরোধ থেকে মুক্তি দেবেন। কি
ন্তু সবাইকে হতাশ করে গতকাল সন্ধ্যায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন জনবিরোধী অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ অবরোধকে কেন্দ্র করে গেল দুই সপ্তাহে দেশের সহায়-সম্পদের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। নিহত, দগ্ধ হচ্ছে মানুষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে ধারণা ছিল, খালেদা জিয়া আপাতত অবরোধ তুলে নিয়ে বিকল্প কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করবেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে হতাশ হতে হয়েছে। সরকার খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল গত রবিবার গভীর রাতে। সাড়ে ৩টার দিকে গুলশানের কার্যালয়ের সামনে থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে নেওয়া হয়, ৮৬ নম্বর সড়কটি সর্বসাধারণের চলাচলের জন্যও খুলে দেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার ব্রিফিং : গতকাল সন্ধায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে খালেদা জিয়া জানালেন, অবরোধ চলছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তা চলবে। তিনি আরো ইঙ্গিত দেন, আপাতত গুলশান অফিসেই থাকবেন তিনি। সাংবাদিকদের এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমার অফিস, এখানে আমার নানা কাজকর্ম থাকে। যখন যেখানে যাওয়া দরকার, যেতে পারলে বুঝব পুলিশ অবরোধ তুলে নিয়েছে। সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ছবি : কালের কণ্ঠ গত ৩ জানুয়ারি রাত থেকে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন খালেদা জিয়া। গতকালই প্রথমবারের মতো সেখানে নেতা-কর্মীরা বিনা বাধায় ঢুকতে পেরেছে। এ পরিস্থিতিতে স্থায়ী কমিটির ৯ জন নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সন্ধ্যা ৭টায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিএনপি নেত্রী। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, জনগণের ভোট দেওয়ার যে অধিকার কেড়ে নিয়েছেন, তা ফিরিয়ে দিন এবং অবিলম্বে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ নিন। পাশাপাশি দেশে এখন যেসব নাশকতা চলছে তার জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, এর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। কোন দাবি মানা হলে অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে জানতে চাইলে বিএনপি নেত্রী বলেন, উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমরা চেয়েছি সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন। তিনি বলেন, চলমান সংকট নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত নয়, এটি রাজনৈতিক সংকট এবং এ সংকট রাজনৈতিকভাবেই সরকারকে সমাধান করতে হবে। লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া শত প্রতিকূলতার মধ্যে দায়িত্ব পালনের জন্য সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানান। এ ছাড়া অবরুদ্ধ অবস্থায় খোঁজখবর নেওয়ার জন্য উৎকণ্ঠিত দেশবাসীর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দেশি-বিদেশি শুভান্যুধায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। গত ৫ জানুয়ারি গুলশান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, এই কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে আমাদের তালাবন্দি করে রাখা হয়। ট্রাক, জলকামান, সাঁজোয়া যান দিয়ে সড়ক অবরোধ করা হয়। অবরুদ্ধ অবস্থায় আমাদের ওপর নিষিদ্ধ পিপার স্প্রে ছোড়া হয়। এর বিষক্রিয়ায় আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। কী অমানবিক আচরণ আমাদের ওপর করা হয়েছে, তা দেশবাসী দেখেছে। গত এক বছরের চিত্র বর্ণনা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, অতীতের ধারাবাহিকতায় এক বছর ধরে আমাদের এবং দেশবাসীর ন্যূনতম অধিকারগুলো হরণ করা হয়েছে। জুলুম-নির্যাতন, গুম-খুন, হামলা-মামলা চালানো হয়েছে। কেমন জঘন্য ও উস্কানিমূলক ভাষায় আমাদের ক্রমাগত আক্রমণ করা হয়েছে, তা দেশবাসী জানে। এর পরও আমরা বারবার একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আলোচনার আহ্বান জানিয়েছি। আলোচনার ভিত্তি হিসেবে সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেছি। তারা আমাদের আহ্বান ও প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে অস্ত্রের ভাষায় সব দমিয়ে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র নেতারাসহ সারা দেশে নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করেছে। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। মিছিলের ওপর গুলি করেছে। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধ কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছি। তিনি বলেন, কর্মসূচি চলছে এবং পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। সারা দেশে বিএনপি ও ২০ দলের নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ বিরাট মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামছে। সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে গুলি চালানো হচ্ছে। কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করা হচ্ছে। পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতাসীনদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরাও হামলা করছে। এর মধ্যে গুলিতে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। আমরা তাঁদের প্রতি গভীর সহানুভূতি জানাচ্ছি।' বিএনপি নেত্রী বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সম্পর্কে দেশে-বিদেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা নাশকতা ও অন্তর্ঘাতের পথ বেছে নিয়েছে। পুলিশি পাহারার মধ্যে নারী, শিশু, ছাত্রছাত্রীদের বহনকারী যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে অনেক নিরপরাধ মানুষকে হতাহত ও দগ্ধ করা হয়েছে। এসব পৈশাচিক বর্বরতার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি ও ২০ দল নিরীহ নিরপরাধ জনগণকে হত্যা ও তাদের ওপর আক্রমণ করা কিংবা তাদের পুড়িয়ে মারার নৃশংস অপতৎপরতায় বিশ্বাস করে না। মানুষের জীবনের বিনিময়ে আমরা রাজনীতি করতে চাই না, কখনো করিনি। অতীতে যাত্রীবাসে গানপাউডার দিয়ে আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারা, বোমা মেরে ও লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে মানুষ হত্যা এবং পুলিশ খুনের অপরাজনীতি আওয়ামী লীগই করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, ঘটনাস্থল থেকে ঘাতক বোমাবাজদের গ্রেপ্তার না করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঘরবাড়িতে হানা দিয়ে তাদের আটক করা হচ্ছে। মহিলাসহ পরিবারের সদস্যদের হেনস্তা করা হচ্ছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে বিভিন্ন জনপদে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হচ্ছে। এসব হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের আগামীতে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতীত নিরপেক্ষ ঐতিহ্য বহাল রেখে আইনসম্মতভাবে কর্তব্য পালনের আহ্বান জানাচ্ছি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় এখনো অবরুদ্ধ থাকার ঘটনা উল্লেখ করে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, দলের নেতা-কর্মীরা কেউ নিরাপদে বাসায় থাকতে পারে না। হত্যার উদ্দেশ্যে রিয়াজ রহমানের ওপর গুলি হয়েছে। তাঁর গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। বিএনপি নেতা সাবিহ উদ্দিনের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। আমাদের দলের অনেক সিনিয়র নেতার বাসা ও অফিসে গুলি ও বোমা হামলা হয়েছে। কাউকে ধরা হয়নি। অথচ ঘটনাস্থল থেকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র, বোমা, গুলিসহ ধরা পড়েছে। তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়া বলেন, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতি আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সব প্রতিকূলতার মধ্যে, নির্যাতন সয়ে অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার জন্য বিএনপিসহ ২০ দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতাসীনরা যদি শুভবুদ্ধি-প্রণোদিত হয়ে আমার কার্যালয় থেকে গতকাল গভীর রাতে বিনা ঘোষণায় অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়ে থাকে তাহলে আমি তা স্বাগত জানাই। আমি তাদের হিংসা ও নাশকতা, অন্তর্ঘাত ও জুলুমের পথ থেকে সরে আসার আহ্বান জানাই। অন্যান্যের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, আ স ম হান্নান শাহ, ড. আবদুল মঈন খান, সরোয়ারী রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নজরুল ইসলাম খান, বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, সাংবাদিকদের পীড়াপীড়িতে নয়, সরকারই অবরোধ কর্মসূচি দিতে বাধ্য করেছে। অবরোধ যেহেতু বিএনপি ডেকেছে ফলে ওই কর্মসূচিকে ফিরে নাশকতার দায়দায়িত্ব বিএনপি নেবে না কেনো-এর জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন দাবি করেন, এ ধরনের ঘটনা আমরা ঘটাইনি। আওয়ামী লীগ সব সময় এ ধরনের কাজ করে থাকে। এর আগেও তারা গানপাউডার দিয়ে লোক পুড়িয়েছে। আমাদের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে, হত্যা করেছে। এসব ঘটনার সঙ্গেও আওয়ামী লীগই জড়িত, আমরা কখনো গানপাউডার ব্যবহার করি না। হতাশ মানুষ : দুপুরের পর থেকেই গুঞ্জন ছিল খালেদা জিয়া কথা বলবেন। বাসা কিংবা অফিস, যে যেখানে ছিলেন টেলিভিশন সেটের সামনে বসে ছিলেন। আশা ছিল, তিনি হয়তো দুই সপ্তাহের অবরোধের অবসান ঘটাবেন। আতঙ্ক থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে সাধারণ মানুষ, শিশুদের নির্ভয়ে স্কুলে পাঠানো যাবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ফিরবে স্বাভাবিক ছন্দ, অফিসে বা দূরের যাত্রায় পেট্রলবোমার ভয় থাকবে না। সন্ধ্যায় টেলিভিশনে সরাসরি খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুনে সবার সেই আশা নিভে যায়। খালেদা জিয়ার অবরোধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা জনমনে কী প্রভাব ফেলবে- জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা হতাশ হয়েছি। ভেবেছিলাম তিনি নতুন কোনো চিন্তা করবেন। জনগণও হতাশ হবে, কারণ তারা আশা করেছিল এবার অবরোধ থেকে হয়তো রেহাই পাওয়া যাবে। অবরোধ কর্মসূচিতে অনড় থেকে খালেদা জিয়া তাঁর দল ও জোটের কর্মী-সমর্থকদের হয়তো চাঙ্গা রেখেছেন, একই সঙ্গে সরকারকেও কঠিন কোনো বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ শ্রমজীবী-কৃষিজীবী-পেশাজীবী মানুষ যে স্বস্তির অপেক্ষায় ছিল, খালেদা জিয়ার বক্তব্যে তার লেশমাত্র ছিল না। পত্রিকা অফিসে ফোন করে এক গৃহবধূর হতাশ কণ্ঠ : অবরোধ তাহলে উঠবে না? প্রাথমিক বিদ্যালয়পড়ুয়া এক শিশুর বাবার খেদোক্তি, এত দিন ছেলেকে স্কুলে পাঠাইনি। কাল থেকে পাঠাব, যা হবার হবে। দুই সপ্তাহের দমবন্ধ করা পরিস্থিতির অবসান চেয়েছিলেন ব্যবসায়ীরাও। কারখানায় উৎপাদিত পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে না, বাড়ছে ব্যাংক ঋণের বোঝা। ব্রিফিং শোনার পর এক শিল্পপতি বললেন, খালেদা জিয়া তো এখন আর অবরুদ্ধ নন। তাহলে কেন তিনি সারা দেশের মানুষকে অবরুদ্ধ করে রাখছেন। খালেদা জিয়ার বক্তব্য সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার শুধু একটি মন্তব্য করেন। বলেন, সহিংসতার দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়ক হবে না। এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, মানুষকে পুড়িয়ে মারা, আগুন দেওয়া জনগণকে আতঙ্কিত করে। মানুষ সাধারণত মনে করে, যে দল কর্মসূচি ডাকছে তারাই তাদের কর্মসূচি সফল করার জন্য এসব করছে। চট্টগ্রামভিত্তিক পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী বলেন, 'আমরা হতাশ, উদ্বিগ্ন। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে আমরা জনমুখী ও দায়িত্বশীল কর্মসূচি আশা করি। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য বৃহত্তর নিরীহ ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা কোনো গণতান্ত্রিক দলের কাছ থেকে কাম্য নয়। বিশেষ করে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছ থেকে নয়, যিনি বিশ্বাস করেন ব্যক্তি থেকে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ।' আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া : খালেদা জিয়ার অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাকে মানুষ হত্যা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা বলে আখ্যায়িত করেছেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল রাতে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। হাছান মাহমুদ বলেন, 'আমরা আশা করেছিলাম খালেদা জিয়া জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে অবরোধ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেবেন। কারণ জনগণ তো দূরের কথা, তাঁর নিজ দলের নেতা-কর্মীরাই মাঠে নেই।' তিনি বলেন, এটি অবরোধ নয়, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা, মানুষ হত্যা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা, গাড়ি পোড়ানোর ঘোষণা। হাছান মাহমুদ বলেন, 'আমরা আশা করব, খালেদা জিয়া অবিলম্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করবেন। হরর মুভির নায়িকার মতো মানুষ পুড়িয়ে উল্লাস বন্ধ করবেন এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসবেন।' সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, কার্যনির্বাহী সদস্য সুজিত রায় নন্দী, সংসদ সদস্য সাইমন সরোয়ার কমল প্রমুখ। ১৪ দলের প্রতিক্রিয়া : অবরোধ চলবে- বিএনপি চেয়ারপারসনের এ ঘোষণাকে অসাংবিধানিক ধারায় ক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র বলে অভিমত দিয়েছেন ক্ষমতাসীন ১৪ দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁরা গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বালাও-পোড়াও অব্যাহত রেখে খালেদা অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান দেখতে চান। এটি তাঁর হঠকারী সিদ্ধান্ত। তবে সরকারের দৃঢ়তায় তাঁর এ তৎপরতা সফল হবে না। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, এত দিন ধরে ২০ দলীয় জোট ও দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী বলছিলেন, খালেদাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, তাঁকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না বলে অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। কিন্তু আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, খালেদা জিয়ার নীতিই হলো সহিংস রাজনীতি। আমরা যে পদক্ষেপই নিই না কেন, তিনি সে পথেই হাঁটবেন। তিনি সহিংসতা চালিয়েই যাবেন। এটিই এখন তাঁর লক্ষ্য। আইন, বিচার ও জাতীয় সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরো বলেন, খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। এখন আমরা এর বিরুদ্ধে আমাদের রাজনীতি করে যাব। দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, খালেদা জিয়া অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর দল ও জোটের নেতা-কর্মীরা মাঠে নামছে না। অবরোধের নামে যেটা হচ্ছে তা হলো সন্ত্রাসী তৎপরতা। খালেদা অবরোধের নামে এ তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। এটি পরিপূর্ণ অগণতান্ত্রিক কাজ। তিনি একটি অসাংবিধানিক ধারা সৃষ্টির জন্য ষড়যন্ত্র করছেন বলে আমার বিশ্বাস। জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ভাষ্য, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মসূচি চালিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন খালেদা জিয়া। অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, উনি গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আস্থা রাখেন না। জনগণকে জ্বালানো-পোড়ানোর এ রাজনীতি অমানবিক ও হঠকারী। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জেলে যাওয়ার ভয়ে খালেদা অসহিষ্ণু ও মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি এখন যেকোনো মূল্যে সরকারকে উৎখাত করতে চান। নিজে ক্ষমতায় আসতে পারবেন না, জেনেও খালেদা এটি করছেন তৃতীয় একটি শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে। যাতে তাঁর নিজের ও সন্তানদের দুর্নীতির দায়ে সাজা পেতে না হয়। খালেদা জিয়ার অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণার বিষয়ে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, বিএনপি এখন আর কোনো গণতান্ত্রিক দল নয়। তারা এখন আর রাজনীতি করছে না। একটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে তারা এখন সন্ত্রাসবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরিফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় প্রমাণিত হলো রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে খালেদা জিয়ার আন্তরিকতা নেই। তাঁর উদ্দেশ্য ভিন্ন। তিনি বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। এ কারণে তিনি মানুষ পুড়িয়ে মারার কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়ার ঘোষণায় জনগণের দুর্ভোগ আরো বাড়বে বলে মনে করেন সিপিবি-বাসদ ঐক্যের নেতারাও। গত কয়েক দিন ধরে দল দুটি বিরোধীদের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি এবং সহিংসতা পরিহার করতে ২০ দলীয় জোটের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল। সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম বিরোধী দলের প্রতি নিপীড়ন না করতে। আর বিএনপি জোটকে আহ্বান জানিয়েছিলাম সহিংসতা না চালাতে। তবে বাস্তবতা হলো যখন শেখ হাসিনা একটু নমনীয় হন, তখন খালেদা জিয়া আরো কঠোর। আবার খালেদা জিয়া একটু নরম হলে শেখ হাসিনা কঠোর হন। প্রকৃতপক্ষে দেশের বাইরে থেকে এ খেলা চালানো হচ্ছে। যে কারণে সময় থাকতে কারো শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে না। মাঝখান থেকে দেশের মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ হচ্ছে।      

No comments:

Post a Comment