Sunday, March 15, 2015

পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার স্বরূপ ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি:প্রথম অালো

বড় বড় চোখ, রক্তলাল জিব আর বিষদাঁত। ছবির নিচে ক্যাপশন ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। ছবিটি পুরো দেশের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়া নামের এক দানবের সঙ্গে। আজও বাংলাদেশের মানুষের চোখে হানাদারের প্রতিকৃতি হয়ে আছে শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ওই পোস্টার। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামরুল হাসান তাঁর সহশিল্পীদের বলেছিলেন, যুদ্ধে একজন শিল্পীর হাতিয়ার তাঁর রংতুলি। কামরুল হাসান তাঁর
হাতিয়ার দিয়ে আঁকেন ইয়াহিয়ার রক্তচোষা দানবমূর্তি। শেষে তা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর স্বরূপ হিসেবেই সারা বিশ্বের কাছে পরিচিতি পায়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হলে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর্ট ও ডিজাইন সেন্টার গড়ে তোলা হয়। বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব নেন শিল্পী কামরুল হাসান। তাঁর অধীনে শিল্পী নিতুন কুন্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, নাসির বিশ্বাস, প্রাণেশ মণ্ডল ও বীরেন সোম নকশাবিদ হিসেবে যোগদান করেন। প্রবাসী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে নকশা বিদের দায়িত্ব পালন করা শিল্পী বীরেন সোম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন কামরুল হাসান আমাদের সঙ্গে বসতেন। সবাই পোস্টারের নকশা তৈরি করতাম। কামরুল ভাইও কিছু খসড়া করলেন। তার ভেতর তিন থেকে চারটি ড্রয়িং হিংস্র দানবরূপী ইয়াহিয়া খানের একটি মুখাবয়ব। সেখান থেকে দুটি ড্রয়িং নিয়ে আরও বোল্ড ব্রাশিং করে লাইনের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার দানবমূর্তির রক্তচোষা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলছিলেন।’ কামরুল হাসান মূলত দুটি পোস্টার করেছিলেন। একটি ছিল ইয়াহিয়ার রক্তচোষা মুখমণ্ডল, হাঁ-করা মুখে দুই দিকে দুটো দানবিক দাঁতে লাল রক্ত ঝরছে। বড় দুটো চোখ আর খাড়া বড় কান দেখলেই মনে হয় রক্তপায়ী এক দানব। আরেকটি পোস্টারে ছিল সম্মুখ দিকে তাকানো বড় বড় রক্তচক্ষু, কান দুটো হাতির কানের মতো খাড়া। মুখ কিছুটা বন্ধ। ঠোঁটের দুই দিকে খোলা, দুই দিকে চারটি দাঁত বের করা। ইয়াহিয়ার এ প্রতিকৃতিতে বিশ্বের সব গণহত্যাকারীর চিত্র ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কামরুল হাসানের আবেগের বহিঃপ্রকাশ গণহত্যাকারীর এই প্রতিকৃতি। এ প্রতিকৃতির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তাৎপর্য রয়েছে। ২৫ মার্চের যে গণহত্যা, তার মূল নায়ক ইয়াহিয়াকে ভয়াল রূপে এঁকেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানিদের নৃশংসতা উপলব্ধি করাতে এটিকে বিদেশে প্রচারের ব্যবস্থা করে।’ পোস্টারটি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই ছাপিয়েছিল প্রবাসী সরকার। বাংলায় ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ এবং ইংরেজিতে ‘এনিহিলেট দিজ ডেমনস’ লেখা পোস্টার মুক্তাঞ্চল, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প, শরণার্থী শিবিরগুলোতে বিলি করা হয়। শিল্প সমালোচক মঈনুদ্দিন খালেদ জানালেন, স্পেনের গৃহযুদ্ধের খলনায়ক ফ্রাঙ্কোকে নিয়ে এমনই মুখচিত্র এঁকেছিলেন শিল্পী পাবলো পিকাসো। মঈনুদ্দিন খালেদ বলেন, কামরুল হাসান ছিলেন রাজনীতিসচেতন শিল্পী। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে দানবের এ ছবি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলিল। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের কাছেও এ পোস্টার হানাদারের প্রতীক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাসরিন আকতার এটিকে মনে করেন পাকিস্তানি নৃশংসতার স্মারক। নাসরিন বলেন, ‘শুধু অস্ত্রের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়নি। সাংস্কৃতিক যুদ্ধও তাতে ভূমিকা রেখেছে। আমরা যাঁরা যুদ্ধ দেখিনি, তাঁদের কাছে এ ছবি পাকিস্তানি শাসকদের নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবিম্ব।’ কামরুল হাসানের মেয়ে সুমনা হাসান বলেন, একটি ছবি অনেক কিছুর উত্তর দিয়ে দেয়। পোস্টারটি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এবং সারা বিশ্বের কাছে যুদ্ধের বার্তা বহন করেছে। সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছাপা এ পোস্টার। চাইলে সংগ্রহও করা যাবে জাদুঘরেরই ছাপানো আড়াই ফুট দৈর্ঘ্য ও দেড় ফুট প্রস্থের এ পোস্টার।

No comments:

Post a Comment