Sunday, March 15, 2015

হরতাল–অবরোধ অকার্যকর, বিকল্প পাচ্ছে না বিএনপি:প্রথম অালো

অবরোধ-হরতাল এখন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তার পরও একই কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। জেনে-বুঝেও কেন একই কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হচ্ছে, এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে। বিএনপিসহ জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা নিজেরাও বুঝতে পারছেন যে টানা দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে চলে আসা এ কর্মসূচি নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। এর প্রতি মা
নুষেরও কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু তাঁরা বিকল্প কোনো কর্মসূচি খুঁজে পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় আবারও ৭২ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ২০-দলীয় জোট। আজ রোববার সকাল ছয়টা থেকে আগামী বুধবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত এ হরতাল চলবে। গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লা জোটের পক্ষ থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা দেন। বিবৃতিতে গুম-খুন-অপহরণ, নেতা-কর্মীদের অন্যায়ভাবে রিমান্ডে নেওয়া, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদকে ‘গ্রেপ্তার’-এর প্রতিবাদে এই হরতাল দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চলছে। কিন্তু ইতিমধ্যে এই কর্মসূচি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। রাজধানী ঢাকাসহ জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে যান চলাচল এখন প্রায় স্বাভাবিক। ফিরে এসেছে চিরাচরিত যানজটও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সারা দেশে হরতাল ডাকি, কেবল ঢাকায় নয়।’ বিএনপির নেতারা প্রকাশ্যে তাঁদের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিকে অকার্যকর বলতে চান না। তবে কেউ কেউ পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করছেন যে এ ধরনের কর্মসূচি গুরুত্ব হারিয়েছে। উপরন্তু নাশকতা ও পেট্রলবোমা হামলার কারণে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, বিকল্প কর্মসূচি হিসেবে অসহযোগ কর্মসূচির কথা ভেবে রেখেছিলেন নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু অবরোধ-হরতালের মধ্যেও রাজধানীর জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক দেখে নেতারা এখন আর অসহযোগের কর্মসূচি দিতে সাহস পাচ্ছেন না। দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, এ দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনে হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগকে সবচেয়ে কঠোর কর্মসূচি মনে করা হয়। এর মধ্যে বিএনপি জোট টানা দুই মাসের বেশি সময় ধরে হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। এত লম্বা সময় কর্মসূচি চালানোর নজির এ দেশে নেই। তাই এ পর্যায়ে হয়তো কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তবে ঢাকার বাইরে হরতাল-অবরোধের প্রভাব রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। বিএনপির নেতাদের দাবি, সরকার র্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে গুম-খুনসহ দমন-পীড়ন চালিয়ে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা অসম্ভব করে তুলেছে। কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিয়েছে। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত বিরোধী দলের নেতারা নিজ ঘরে ঘুমাতে পারছেন না। এমনকি রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টিও দুই মাসের বেশি সময় ধরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে পুলিশ। এমন পরিস্থিতিতে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচির বাইরে আর কোনো বিকল্প দেখছেন না জোটের নীতিনির্ধারকেরা। পিছু হটার সুযোগ নেই বলেও মনে করছেন তাঁরা। একই সঙ্গে সংলাপ-সমঝোতার লক্ষ্যে দেশ-বিদেশের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার কার্যক্রমও অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বলেছেন, যতক্ষণ না আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে। তা ঠিক আছে। এর পাশাপাশি বড় ধরনের সমাবেশ করা গেলেই বরং আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে ত্বরান্বিত করা যাবে। আর জোটের শরিক ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, সংকটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। এখন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে কি, হচ্ছে না এ নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া আছে। এটি অন্ধের হাতি দেখার মতো। যদিও বিএনপির প্রতি দলটির দেশ-বিদেশের শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ ছিল, আন্দোলন কর্মসূচিতে যেন ছাড় দেওয়া হয়। সংলাপের ইঙ্গিত পেলে কর্মসূচিতে ছাড় দিতে দলের নীতিনির্ধারকেরা রাজি আছেন। দলটির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, ওই ছাড় বা সমঝোতার আবহ তৈরির লক্ষ্যে ‘নমনীয়’ মনোভাব পরিষ্কার করতেই ৫৩ দিন পর গণমাধ্যমের সামনে হাজির হন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর মধ্য দিয়ে সংলাপের জন্য বিএনপির উদারতা, চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা এবং আন্দোলনে নেমে নেতা-কর্মীদের গুম, খুন, অপহরণ ও নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনাগুলো দেশবাসীর সামনে আবারও তুলে ধরা হয়। বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ১৬ জন বিদেশি কূটনীতিক সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ‘সেতুবন্ধে’ যে উদ্যোগ নেন, খালেদা জিয়ার প্রতি তাঁদেরই একটি বার্তা ছিল চলমান কর্মসূচি কাটছাঁটের। যাতে সরকার তা আস্থায় নেয় এবং কূটনীতিকদের দূতিয়ালিতে সুবিধা হয়। এর বিনিময়ে বিএনপি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কী কী চায় এবং ছাড় দিলে কীভাবে, কতটুকু দেবে, তারও একটি লিখিত প্রস্তাব চাওয়া হয় কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কূটনীতিকদের চাহিদা অনুযায়ী, বিএনপির পক্ষ থেকে একটি লিখিত প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। যদিও তা এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে কূটনীতিকদের জন্য তৈরি করা প্রস্তাবের অনেকগুলো বিষয় প্রকাশ করেছেন। খালেদা জিয়ার ভাষায়, ‘বিরাজমান সমস্যার সমাধানে’ প্রথমে গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্তি, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, পুলিশি ও যৌথ বাহিনীর ‘হয়রানি’ বন্ধ করতে হবে। এরপর সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত সব ধরনের বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করতে হবে। সবশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দ্রুত সংলাপের আয়োজন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কূটনীতিকেরা সক্রিয় হলে বা তাঁদের উদ্যোগ আলোর মুখ দেখলে চলতি সপ্তাহের হরতাল কর্মসূচি কাটছাঁট করা হতে পারে। বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, সংবাদ সম্মেলনে ‘নমনীয়’ বক্তব্য দিয়ে খালেদা জিয়া একদিকে চলমান উত্তেজনা প্রশমনের নিজের আন্তরিকতা প্রকাশ করেছেন; আরেক দিকে দীর্ঘদিন পর নতুন করে বক্তব্য দিয়ে দল ও জোটের নেতা-কর্মীদের আন্দোলনে আরেক দফা সক্রিয় করার চেষ্টা রয়েছে। পাশাপাশি সংলাপের আহ্বান করে সরকারের পক্ষ থেকে এর প্রতিক্রিয়া কী দেখানো হয়, তা-ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানোর একটা কৌশল রয়েছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) আন্তরিকভাবে চলমান সংকটের সমাধান চাইছেন। সারা দেশ অবরুদ্ধ, দেশে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তিনি সত্যিকার অর্থেই এর সমাধান চাইছেন।

No comments:

Post a Comment