Tuesday, March 17, 2015

ভাঙাচোরা রাস্তা আবর্জনা আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নাভিশ্বাস:কালের কন্ঠ

বনানীর ১১ নম্বর সড়কটির দুই পাশে শত শত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আর এ সড়কের সঙ্গে বিভিন্ন সংযোগ সড়কের অর্থাৎ ২৮টি সড়কের পাশেও কমবেশি দোকানপাটসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। অথচ রাজধানীর সবচেয়ে অভিজাত আবাসিক এলাকার মধ্যে বনানী একটি। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যে এই আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠেনি। সঙ্গে চলাচলের অনুপযোগী রাস্তাঘাট, খোলা ড্রেনেজ-স্যুয়ারেজ, জলাবদ্ধতা, ময়লা-আবর্জনা, সন্ত্রাস-চাঁদা
বাজি, লেক দখলসহ নানা সমস্যা তো রয়েছেই। আশানুরূপ নয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও। প্রতিনিয়তই চুরি-ছিনতাই, মাদক ও অপহরণসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। আবার কড়াইল বস্তির মাদকও পুরো এলাকায় ছড়িয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছে কেউ কেউ। সরেজমিনে ঘুরে বনানী, কাকলী, গুলশান-২, কড়াইল বস্তি, নিকেতন, টিঅ্যান্ডটি কলোনি, চেয়ারম্যানবাড়ী এলাকায় নানা সমস্যার চিত্র দেখা যায়। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম এনামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বনানী এলাকার উন্নয়নে আমরা বিশাল অঙ্কের বাজেট রেখেছি। খুব দ্রুত বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নকাজ শুরু করব।' আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে বি এম এনামুল আরো বলেন, 'রাজউক ২০০৭ সালে আমাদের আবাসিক এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। সেই থেকে আমরা ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছি। কিন্তু রাজউক কর্তৃপক্ষ অনেক আবাসিক ভবনকে প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে আমাদের ট্রেড লাইসেন্স না নিয়েই ব্যবসা করে যাচ্ছে। ফলে আমরা বড় আকারে রাজস্ব হারাচ্ছি। আর যারা অনুমোদন ছাড়া আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে তিন সংস্থার যৌথ অভিযান চলবে।' সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বনানী এলাকায় নান্দনিক ভবন, লেক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দূতাবাস, শপিং সেন্টার, পার্ক রয়েছে। কিন্তু খোলা ড্রেনেজ, জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে বসবাসের জন্য লোকজন আর আগের মতো পছন্দ করে না। বনানীর বেশির ভাগ এলাকায়ই খোলা ড্রেন চোখে পড়ে। বনানীর ১৭ নম্বর সড়কের বেশ কিছু স্থানে খোলা ড্রেন রয়েছে। বনানী কাঁচাবাজারের সামনে নোংরা ও আবর্জনায় ভরপুর একটি খোলা ড্রেন রয়েছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। এ ছাড়া ডি-ব্লকের ৮ নম্বর সড়কে নির্মাণ বর্জ্য, ১১ নম্বর সড়কের বেশ কিছু জায়গায় ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা রয়েছে। আবার একই রাস্তার মিডিয়ানের ওপর নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে। বনানী সি-ব্লকের ৬ নম্বর রোডের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্ধিতাংশ অফিসের দেয়াল ঘেঁষেই ১৭ নম্বর সড়ক। বনানী ঝিলপাড় থেকে মসজিদ পর্যন্ত এ রাস্তাটি তিন বছর ধরে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। একটু বৃষ্টি হলেই এ রাস্তা দিয়ে হেঁটেও চলাচল করা যায় না। বনানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এমন রাস্তা দেখার যেন কেউ নেই।' আবার কাঁচাবাজারসংলগ্ন ময়লার কনটেইনারও দুর্ভোগের আরেক কারণ। বনানী কাঁচাবাজারের ফল বিক্রেতা আজিম উদ্দিন শেখ বলেন, 'প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসে এ বাজারে। বাজারের প্রবেশপথে এমন ময়লার স্তূপের কারণে নাক চেপে চলাচল করতে হয়। সিটি করপোরেশনের অফিসে গিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে একাধিকবার অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।' সিটি করপোরেশন ও রাজউক সূত্রে জানা যায়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অনুমোদিত আবাসিক এলাকা বনানীতে অবৈধভাবে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০০৭ সালের ১২ আগস্ট ঢাকা মহানগরীর রাজউক, গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রণালয়, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আবাসিক এলাকায় কোনো ট্রেড লাইসেন্স অর্থাৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নাবায়ন না করার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর পর থেকে নির্দিষ্ট আবাসিক এলাকায় পুরনো প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেয়নি সিটি করপোরেশন। কিন্তু তাদের কোনো পদক্ষেপই যেন রুখতে পারেনি। রাজউকের উপপরিচালক (গুলশান-বনানী) মো. ইফতেখারুজ্জামান চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যেসব আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তাদের নামের তালিকা করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তালিকা তৈরির কাজটি চলমান রয়েছে।' বনানী এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। নিজ বাসাবাড়ির নিচে, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে চলছে অফিস, দোকানপাট, কারখানা, বুটিক হাউস, বিউটি পার্লার, বিদেশ গমনেচ্ছুদের মেডিক্যাল চেকআপসহ নানা ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এমনকি কোথাও কোথাও ছোট ও মাঝারি মানের কারখানা তৈরি করা হয়েছে। বিকট শব্দ আর পরিবেশদূষণ নিয়ে আবাসিকদের বসবাস করতে হচ্ছে। এ আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে গেস্টহাউস ও হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব বন্ধে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, 'গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি এলাকায় আবাসিক প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও এখন এসব স্থানে বাণিজ্যিক স্থাপনা চোখে পড়ে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কারণে আবাসিক এলাকাগুলো তাদের সৌন্দর্য হারাচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা নেব।' এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বনানী এলাকায় আরেক সমস্যা জলাবদ্ধতা। যেকোনো পরিমাপের বৃষ্টি হলেই কয়েকটি রাস্তা তলিয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে থাকে। পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা ভালো না থাকায় অল্প এ ধরনের সমস্যা হয়। এসব সমস্যার মধ্যেই বসবাসকারী মানুষকে আশ্বস্ত করছেন আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভাব্য কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা। বনানী, কাকলী, গুলশান-২, কড়াইল বস্তি, টিঅ্যান্ডটি কলোনি, চেয়ারম্যানবাড়ীসহ বেশ কিছু স্থানে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা প্রচারণা শুরু করেছেন। ব্যানার, ফেস্টুন ও লিফলেটে শুরু হয়েছে প্রচার-প্রচারণা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হলেও এই ওয়ার্ডে প্রচারণায় বসে নেই প্রার্থীরা। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় এলাকার উন্নয়ন অনেকটা স্থবির, জনদুর্ভোগ বেড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনগণের কাছাকাছি আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো নির্বাচনের আমেজ ফুটে ওঠেনি। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, গুলশান থানা যুবলীগের আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম হৃদয়, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মফিজুর রহমান নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এলাকার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নজরুল ইসলাম হৃদয় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রায় দেড় লাখ জনসংখ্যার এ ওয়ার্ডে নানা নাগরিক ভোগান্তি রয়েছে। স্থানীয় প্রতিনিধি না পেয়ে সাধারণ মানুষ তাদের অভাব-অভিযোগ জানাতেও পারছে না। তাই আমার বিশ্বাস, নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি পেলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।' সরেজমিনে ঘুরে আরো দেখা যায়, দখল আর দূষণে একাকার গুলশান-বনানী লেক। লেকের বিভিন্ন অংশ ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নিয়মিত পরিষ্কার না করার ফলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, 'যারা ক্ষমতায় যায় তাদের ছত্রচ্ছায়ায় মূলত লেক ভরাট হয়ে থাকে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক ভবনগুলো থেকে ময়লা-আবর্জনাও লেকের মধ্যে ফেলা হয়। মাঝেমধ্যেই লেক থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের পর আবার ক্ষমতার দাপটে স্থাপনা নির্মাণ করে। লেকের সঙ্গে ড্রেনেজ-স্যুয়ারেজের সংযোগ আবার দেওয়া হয়েছে। ফলে একটি নান্দনিক লেক থাকলেও তা আমাদের তেমন কাজে আসে না।'

No comments:

Post a Comment