Saturday, March 28, 2015

সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে ভারতকেই:প্রথম অালো

জলজঙ্গল দ্বীপমালা ঘেরা সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে, ৪০ শতাংশ ভারতে। বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের সংকটও বেড়ে চলেছে। কীভাবে এ দুই দেশ যৌথভাবে সেই সংকট ও সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে, তারই সন্ধানে ছিল এই যাত্রা। আজ শেষ পর্ব সুন্দরবন কি একা একা বাঁচতে পারবে? মানে, বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন কিংবা ভারতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সুন্দরবন? এক বর্ণের ও এক শব্দের উত্তর হলো
, ‘না’। কেন নয়? কারণ, সুন্দরবন এই দুই দেশেই ছড়িয়ে রয়েছে তার যাবতীয় রূপ, রহস্য ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে। তাকে ঠিকমতো রক্ষা করতে গেলে দুই দেশকেই একই ছাতার তলায় আসতে হবে। বাড়াতে হবে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত। বুঝতে হবে সমস্যার সমাধানের চাবিটা আসলে কোথায়। এই যে আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের ২৮ জন সাংবাদিক, পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্বব্যাংকের সদস্যরা কয়েক দিন ধরে সুন্দরবনের জলে-জঙ্গলে ঘুরছি, তার উদ্দেশ্য একটাই—সুন্দরবনের সমস্যাগুলো বাংলাদেশ বা ভারত এ রকম আলাদাভাবে না দেখে এক জোট হয়ে হাতে হাত মিলিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা, যাতে প্রকৃতির এই অনিন্দ্যসুন্দর সম্পদকে এই উপমহাদেশ বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এ যেন সেই দুটি মাথা অথচ এক শরীরের প্রাণী। একটির ঔদাসীন্য, অবহেলা ও হঠকারিতায় দুজনেরই মৃত্যু অনিবার্য। আইলার ক্ষত এখনো শুকায়নি দেশ বিভাগ সুন্দরবনের ৬০ ভাগ বাংলাদেশকে দিয়েছে, ৪০ ভাগ ভারতকে। চরিত্র এক হলেও অমিলও বেশ কিছু রয়েছে একদা অভিন্ন এখন বিচ্ছিন্ন এই জল-জঙ্গল-দ্বীপমালার। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের তুলনায় বাংলাদেশের সুন্দরবনে সুন্দরীগাছের উচ্চতা বেশি। বাংলাদেশে গোলপাতা গাছ অঢেল, যার তলায় কুমিরেরা ভাটার সময় আলসেমি করতে করতে রোদ পোহায়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে এই গাছ অদৃশ্য। ভারতের সুন্দরবনে মানুষ ও বাঘের সহাবস্থান ও সংঘর্ষ দিবারাত্রির দিনলিপি, বাংলাদেশের সুন্দরবন মানুষ ছাড়া প্রাণিজগতের বাকিদের নির্ভয় নিরাপদ বিচরণভূমি। ভারতের সুন্দরবনের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল মানুষের কাছে নিষিদ্ধ ভূমি, বাংলাদেশে সর্বত্র নাকি পর্যটকদের জন্য অবারিত দ্বার। মিল-অমিলের এই মিলমিশেই লেখা রয়েছে সুন্দরবনের ললাটলিখন। মাত্র কয়েক শ কিলোমিটারের ব্যবধানে এক জায়গার সুন্দরীগাছ লম্বা, অন্য জায়গায় বেঁটে কী করে হয়? কেনই বা গোলপাতা একদিকে অঢেল, অন্যদিকে অমিল? ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য বুসরা নিশাত তার ব্যাখ্যা দিলেন। জলের লবণাক্ততা। তিনি বললেন, ‘আমাদের সুন্দরবনে পানির লবণাক্ততা ভারতের সুন্দরবনের তুলনায় এখনো কম। মিষ্টি পানিতেই সুন্দরীগাছ ডালপালা ছড়ায়, বিকশিত হয়, চড় চড় করে মাথা ছাড়িয়ে লম্বা হয়।’ গোলপাতাও মিষ্টি জলে লালিত-পালিত। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে লবণাক্ততা এতটাই যে গোলপাতা সেখানে অমিল। অতএব, লবণাক্ততা কমানো সুন্দরবনের জন্য অবিলম্বে জরুরি। কীভাবে? সেটাই জটিল প্রশ্ন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক আতাউর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান কিংবা প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবুসহ বাংলাদেশের সব বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ সাংবাদিকদের অভিমত, মিষ্টি জলের প্রবাহ বাড়াতে ভারতকেই অগ্রণী হতে হবে। কেন? কেননা, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও অধিকাংশ নদীই ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। মোট ৫৪টি নদী অভিন্ন। ভারত থেকে বাংলাদেশ হয়ে তারা সাগরে মিশেছে। বর্ষায় বঙ্গভূমি যখন প্লাবিত, বঙ্গোপসাগর ছোঁয়া সুন্দরবনের লবণাক্ততা তখন কমে যায়। কিন্তু সুখা মৌসুমে ভারত থেকে প্রবাহিত নদীর জলপ্রবাহ ক্রমশই কমে যাওয়ার কারণে জোয়ারের সময় দক্ষিণ থেকে নির্দয় সাগরের লবণাক্ত জল বাংলাদেশের সুন্দরবনকে নোনতা করে ছাড়ছে। সেই সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য ফি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হচ্ছে। সামাল না দিতে পারলে আগামী দিনে এর ফল হবে মারাত্মক। সহাবস্থানে প্রকৃতির সুরক্ষা ভারতীয় সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞরাও তাঁদের মুলুকের সুন্দরবনের লবণাক্ততা নিয়ে একই যুক্তি খাড়া করলেন। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত, সুন্দরবনের স্বার্থে দুই বঙ্গেই দারুণ দাবদাহের সময় মিষ্টি জলের প্রবাহ বাড়ানো দরকার। কিন্তু কীভাবে? এখানেই চলে আসে মূল প্রশ্ন, যার উত্তর বেশ জটিল। বাংলাদেশের সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রক একজনই। বাংলাদেশের সরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের? তার মালিকানা তো বিভাজিত? জল-জঙ্গল পুরোটাই পশ্চিমবঙ্গে হলেও নদীর প্রবাহ বাড়ানোর যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র অধিকার তো শুধুই ভারত সরকারের? পশ্চিমবঙ্গ যে ভারতের স্রেফ একটা অঙ্গরাজ্য? অর্থাৎ সমস্যা। যদি বাঘই একমাত্র বিবেচ্য হয়, তাহলে সুন্দরবনই ভারতের একমাত্র বাঘের বিচরণভূমি নয়। গোটা দেশে নয় নয় করেও ৩৯টি ব্যাঘ্র প্রকল্প রয়েছে। অর্থাৎ সুন্দরবন ৩৯টির একটি। পরিবেশ রক্ষাই যদি বিবেচ্য হয়, তা হলেও হিমালয়ের পাদদেশ সুন্দরবনের চেয়েও বেশি বিস্তৃত। জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচ্য হলে গোটা দেশই তার আওতায় পড়ছে। তার মানে, সুন্দরবনকে আলাদা গুরুত্ব দিতে হলে ভারত সরকারকে তার গুরুত্বটা অনুধাবন করাতে হবে। যাতে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে বাধ্য হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সব নয়। বাঙালির পাতে আর কত দিন মাছ পড়বে? সেই জন্যই ডাকা হলো দুই বঙ্গের রাজনীতিকদের। পুবে বিদ্যা ও পশ্চিমে মাতলাকে যে নদীটা জুড়ে দিয়েছে, সেই হেরো ভাঙার মাঝ দরিয়ায় নোঙর করল এমভি পরমহংস। নদীর উত্তরে ঝড়খালীর জেটি। এখান থেকেই একে একে এসে উঠলেন বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনীতির কান্ডারিরা, যাঁদের হাতে রয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দণ্ড, সুন্দরবনের বাঁচা-মরার নিদান যাঁদের হাতে। উদ্যোগটা শুরু হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। পরিবেশ সচেতন সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইএনজিআইওর হোতা জয়ন্ত বসু সেই বছর দুই দেশের তৎকালীন দুই পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও জয়রাম রমেশকে আগ্রহী করে তুলেছিলেন। সরকারি পর্যায়ে কিছুটা আগ্রহ সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু সেটাই তো সব নয়? ভারতে নতুন সরকার এসেছে। এসেছেন নতুন পরিবেশমন্ত্রী। বাংলাদেশেও নির্বাচনের পর বদল ঘটেছে পরিবেশমন্ত্রীর। কিন্তু হাল ছেড়ে বসে না থেকে উদ্যোক্তারা এবার সুন্দরবনের জল-জঙ্গলেই টেনে এনেছেন দুই দেশের রাজনীতিকদের। বাংলাদেশের নেতৃত্বে সাবেক পরিবেশমন্ত্রী বর্তমানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান হাছান মাহমুদ, পশ্চিমবঙ্গের সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের সঙ্গী একাধিক সাংসদ ও বিধায়ক। সুন্দরবনের স্বার্থে সুন্দরবনে থেকে টানা দুই দিন নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করে তাঁরা এক অভিন্ন খসড়া কর্মসূচি গ্রহণের চেষ্টা করবেন, যা দুই দেশের সরকারের কাছে পেশ করা হবে; যাতে আগামী দিনের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের হাত থেকে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের মানুষ, প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করা যায়। বাংলাদেশের জন্য কাজটা সহজতর। সরকার সেখানে একটাই, সুন্দরবনের স্থানও সেই সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকার ওপরের দিকে। ভারতের দিকে কাজটা তুলনামূলক কঠিন। সুন্দরবন নিয়ে ভারত সরকারকে নড়েচড়ে বসাতে গেলে অনেককে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। আর সে জন্যই এত আয়োজন। আয়োজন তো করতেই হবে। সাত মণ তেলই যদি না পোড়ে, রাধা তাহলে নাচবে কেন? (শেষ)

No comments:

Post a Comment