Friday, March 27, 2015

সৌদি-ইরান ছায়া রণক্ষেত্র ইয়েমেন:প্রথম অালো

চার বছর আগে আরব বিশ্বজুড়ে তোলপাড় তুলেছিল আরব বসন্ত নামে পরিচিত হয়ে ওঠা গণ-আন্দোলন। ওই ঘটনার পর যেসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত এই অঞ্চলকে একে একে গ্রাস করেছে, তা মূলত কট্টর সুন্নি ও শিয়াদের মধ্যে লড়াই। মুসলিমদের দুই বড় গোষ্ঠীর এই সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বই এখন এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর এই সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে আঞ্চলিক দুই প্রভাবশালী দেশ: সুন্নিপ্রধান সৌদি আরব ও শিয়াপ্রধান ইর
ান। এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতে যা-ই হোক, ইয়েমেন দৃশ্যত পরিণত হয়েছে এই দুই আঞ্চলিক শক্তির ছায়া রণক্ষেত্রে। ইয়েমেনের রাজধানী সানায় দুটি শিয়া মসজিদের বাইরে সাম্প্রতিক ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা অঞ্চলব্যাপী চলা সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্বেরই সর্বশেষ নজির। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বলি হওয়া এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও বাহরাইন। ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে—এক দশকের বেশি আগে এমন খবর চাউর হওয়ার আগে থেকেই তেহরান-রিয়াদ দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। পারমাণবিক বোমা বানাতে পারলে ইরানের এই অঞ্চলের অদ্বিতীয় পরাশক্তি হওয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে। এতে করে দেশে দেশে ‘ইরানি বিপ্লবের’ মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়া আরও জোরদার করা যাবে। স্বভাবতই ইরানের পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার প্রচণ্ড বিরোধী সৌদি আরব। এটি উপসাগরীয় এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী সুন্নি দেশ। ফলাফল দুই দেশের সম্পর্ক এখন সাপে-নেউলে। এই অঞ্চলের একটি দেশে সংঘাত মানেই সেখানে রিয়াদ ও তেহরানের প্রভাব খাটানোর আরেকটি প্রতিযোগিতা; আরেকটি ছায়াযুদ্ধ। এই তিক্ত বিরোধের আঁচ বর্তমানে ইয়েমেনে যেমনটি অনুভব করা যাচ্ছে, সে রকম আর অন্য কোথাও হয়নি। আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এই দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই সৌদি আরবের প্রভাববলয়ের অধীনে। বেশির ভাগ আরবই দেশটিকে সৌদি আরবের ‘পেছনের উঠান’ বিবেচনা করে। নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ ও উত্তর ইয়েমেন একীভূত হওয়া থেকে শুরু করে সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর দেশের একচ্ছত্র নেতা হওয়া পর্যন্ত সবখানেই রিয়াদ ইয়েমেনের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব দেখিয়েছে। সালেহর শাসনামলেও সৌদি প্রভাব অক্ষুণ্ন ছিল। তবে অন্তত দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা গত এক দশকে পরিস্থিতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে। তা হচ্ছে আল-কায়েদা ইন দি অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (একিউএপি) ও ইরানের মদদপুষ্ট শিয়া হুতিদের উত্থান। একিউএপি প্রয়াত সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী ওসামা বিন লাদেনের প্রতিষ্ঠিত জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার শাখা। আগের তুলনায় শক্তি হারিয়ে ফেলা আন্তর্জাতিক সংগঠন আল-কায়েদার এই শাখাটিই এখন সবচেয়ে শক্তিশালী। একিউএপি ইয়েমেনে জাতিগত ও সামাজিক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। মনে হচ্ছে, দেশটি দ্রুতই গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। ইরানের সমর্থনে উত্তর ইয়েমেনের হুতিদের উত্থান উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আরও বেশি ক্ষমতার দাবিদার হুতিরা গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানী সানা দখল করে নেয়। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট সালেহ গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইয়েমেনে এটা ছিল সবচেয়ে বড় অস্থিরতার ঘটনা। হুতিদের সানার ক্ষমতা দখলের ঘটনা সত্যিকার অর্থেই সৌদি আরবের জন্য একটা বড় ধরনের পরাজয়। এমন প্রেক্ষাপটে সানায় দুই শিয়া মসজিদে চালানো আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তুলনামূলকভাবে নতুন এই জঙ্গিগোষ্ঠীটির সঙ্গে একিউএপির দ্বন্দ্ব থাকলেও উভয়েই সুন্নি। অনেকেরই সন্দেহ, প্রতিবেশী ইয়েমেনে তৎপরতা চালাতে আইএসকে সহায়তা দিচ্ছে সৌদি আরব। যদিও এমনিতে দেশটি আইএসবিরোধী মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়েছে। বিশেষ করে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবেদরাব্বো মানসুর হাদি সানা থেকে দক্ষিণের এডেন শহরে পালিয়ে যাওয়ার পর সেখানে তাঁর বাসভবনে হুতিদের বিমান হামলার সঙ্গে ওই আত্মঘাতী হামলার সময়টা মিলে যাওয়ায় সন্দেহটা হালে পানি পাচ্ছে। অতীতে বাহরাইনের সুন্নি নেতৃত্বাধীন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইরান-সমর্থিত গণবিক্ষোভ দমনে সেনা পাঠাতে দেরি করেনি সৌদি আরব। ইয়েমেনেও সৌদিরা সেই পথে হাঁটবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে তেমনটা হলে তেহরান-রিয়াদ দ্বন্দ্ব যে আরও প্রকট হবে, তা বলাই বাহুল্য।

No comments:

Post a Comment