Tuesday, March 24, 2015

ভাড়ায় উড়োজাহাজ আনতে বড় অনিয়ম:প্রথম অালো

আগের খারাপ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মিসর থেকে আবারও অতিরিক্ত মূল্যে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়ায় আনছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। প্রতিটি ৭৪ আসনের উড়োজাহাজ দুটি পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া করার ক্ষেত্রে দরপত্রের মৌলিক শর্তও লঙ্ঘন করা হয়েছে। বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা শাখার একটি সূত্র জানায়, বোমবাডিয়ার কোম্পানির তৈরি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ দুটির মাসিক ভাড়া, রক্ষাবেক্ষণ খরচসহ সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে বিমানের খরচ হবে প্রায় ৩৮৯ কোটি
টাকা। এ টাকায় এ ধরনের উড়োজাহাজ অন্তত চারটি কেনা সম্ভব। অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ভাড়া করা উড়োজাহাজ দুটি চলতি সপ্তাহে বহরে যুক্ত হওয়ার কথা। এ-সংক্রান্ত বিমানের দাপ্তরিক নথিপত্রে দেখা যায়, দরপত্রে আরও কম ভাড়ায় উড়োজাহাজ ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব পাওয়া গেলেও বিমান কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে তা গ্রহণ করেনি। অথচ দরপত্রের মৌলিক শর্তাবলীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি পূরণ না করা সত্ত্বেও মিসরের স্মার্ট অ্যাভিয়েশন থেকে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া করার চুক্তি করে সরকার। এর নেপথ্যে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। স্মার্ট অ্যাভিয়েশনের প্রস্তাবে মাসিক ভাড়া ১ লাখ ৮৫ হাজার মার্কিন ডলার (১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা) উল্লেখ করা হয়। এর সঙ্গে রয়েছে প্রতি উড্ডয়ন ঘণ্টার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ‘রিজার্ভ’ ৬০০ ডলার। অবশ্য চুক্তি করার সময় ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার মার্কিন ডলার (১ কোটি ৩০ লাখ টাকা)। যদিও অন্য একটি প্রতিষ্ঠান স্মার্ট অ্যাভিয়েশন থেকে মাসিক ভাড়া ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার (৫০ লাখ টাকা) কমে একটি উড়োজাহাজ দিতে চেয়েছিল। দ্বিতীয় উড়োজাহাজ ছয় মাসের মধ্যে একই দরে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপিত এ-সংক্রান্ত নথিতে দেখা যায়, দরপত্রের মৌলিক শর্তে বলা হয়েছে, উড়োজাহাজ সরবরাহের তারিখ থেকে দুই বছরের মধ্যে ‘হেভি মেইনটেন্যান্স চেক’ (বড় রক্ষণাবেক্ষণ) করা যাবে না। কিন্তু যে দুটি উড়োজাহাজ আনা হচ্ছে, সেগুলোর ‘হেভি চেক’ আগামী বছরের জুন ও সেপ্টেম্বরে করতে হবে। আর বিপুল অঙ্কের আর্থিক ব্যয়ে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বর্তাবে বাংলাদেশ বিমানের ওপর। জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাইল হেয়্যুড বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তিনি দাবি করেন, উড়োজাহাজ দুটি সরবরাহের আগেই স্মার্ট অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ‘মাল্টিপল সি-চেক’ (একধরনের রক্ষণাবেক্ষণ) করে দেবে। এ বিষয়ে বিমানের প্রকৌশল শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বেশ কয়েকটি ‘সি-চেক’ একটি ‘ডি-চেকের’ সমান। এ রকম ‘হেভি চেক’ করতে হলে প্রায় এক মাসের মতো সময় লাগে। আর এ দুটি উড়োজাহাজ কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকায় এসে পৌঁছাবে। বিমানের লোকজন ইতিমধ্যে মিসরে পৌঁছে গেছেন। তা ছাড়া বিমানের এমডি যে ‘মাল্টিপল সি-চেকের’ কথা বলেছেন, সেটা হলে ১৫ মাস পর নির্ধারিত ‘হেভি চেক’ লাগবে না, এটা নিশ্চিত করেননি কেউ। শুধু তাই নয়, স্মার্ট অ্যাভিয়েশন তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে উড়োজাহাজ দুটির উৎপাদনের তারিখ, এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র, মালিকানা-সংক্রান্ত কাগজপত্র, সরবরাহসূচি, রক্ষণাবেক্ষণ-সংক্রান্ত দরসহ জরুরি কাগজপত্র দেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দরপত্রে এ ধরনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলে শুরুতেই দরপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেননি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির একটি সূত্র জানায়, পরে বিমানের পরিকল্পনা বিভাগ অতি উৎসাহী হয়ে নিজেরাই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে তা স্মার্ট অ্যাভিয়েশনের দরপত্রে সংযোজন করেছেন। এরপর একমাত্র স্মার্ট অ্যাভিয়েশনকে যোগ্য (রেসপন্সিভ) ঘোষণা করে বাকি আটটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের এমডি প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি মূল্যায়নকালে দরদাতার কাছ থেকে যেকোনো ব্যাখ্যা বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাইতে বা সংগ্রহ করতেই পারে। কিন্তু এর আগে গত বছর দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ভাড়া করার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল, তাতে জিএ টেলিসিস নামে মার্কিন একটি কোম্পানি প্রতিটি মাসিক ১ লাখ ৪০ হাজার ডলারে (এক কোটি নয় লাখ) ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু তাদের জাহাজ দুটির রক্ষণাবেক্ষণের সময়ও দেড় বছরের মধ্যে নির্ধারিত ছিল। তখন জিএ টেলিসিসের প্রস্তাব ছিল যে তারা সরবরাহের আগেই রক্ষণাবেক্ষণের এই কাজ করে দেবে। কিন্তু দরপত্রের মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করার অজুহাতে তা বাতিল করা হয়। তখন এর চেয়ে বেশি দামে মাসে ১ লাখ ৮৪ হাজার ডলার (দেড় কোটি টাকা) ভাড়ায় ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি বোয়িং ভাড়া করা হয়। বিমানের ফ্লাইট পরিচালন শাখার একাধিক সূত্র জানায়, ওই দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে গিয়ে বিমানের প্রথম নয় মাসে ২১০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। এখন সেই ইজিপ্ট এয়ারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্মার্ট অ্যাভিয়েশন থেকে কাছাকাছি ধরে অনেক ছোট উড়োজাহাজ ভাড়া করার চুক্তি হয়েছে। এ ব্যাপারে বিমানের কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিমানে প্রচার রয়েছে যে বোয়িংয়ের মতো ড্যাশ-৮ ভাড়ার ক্ষেত্রেও মধ্যস্বত্বভোগী একই চক্র। বিমান সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য বিমান একই মডেলের যে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির জন্য মাসে পরিশোধ করতে হবে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ ‘রিজার্ভ’ এবং ক্রুসহ আরও খরচ হবে এক কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর বিমান উড়োজাহাজ দুটিকে একদিকে ফেরত দিতে হবে, অপর দিকে ভাড়া গুনতে হবে প্রতিটির জন্য রক্ষণাবেক্ষণ রিজার্ভ, রি-ডেলিভারি পেমেন্টসহ সব মিলিয়ে গড়ে ২৫ মিলিয়ন ডলার। দুটি উড়োজাহাজের পেছনে মোট খরচ হবে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার (৩৮৯ কোটি টাকা)। এ টাকায় একই মডেলের চারটি উড়োজাহাজ কেনা সম্ভব হতো বলে আকাশ পরিবহন ব্যবসায় জড়িত দেশের একাধিক ব্যক্তি জানান। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা জানান, সম্প্রতি দেশের বেসরকারি একটি বিমান সংস্থা ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ মডেলের দুটি উড়োজাহাজ কিনেছে। প্রতিটির দাম পড়েছে সাড়ে সাত মিলিয়ন ডলার (৫৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা)। তবে বিমানের এমডি কাইল হেয়্যুড প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, পাঁচ বছরের ভাড়ার টাকায় এমন দুটি উড়োজাহাজ কেনা যাবে, এটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, উড়োজাহাজ কত বছর আগে তৈরি হয়েছে এবং কারিগরি ও অন্যান্য অবস্থার ওপর এর মূল্য নির্ধারিত হয়। এদিকে বিমানের বিপণন শাখার একাধিক সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে চারটি বেসরকারি বিমান সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে টিকিটের দাম কাছাকাছি রাখতে হবে। আর তা রাখতে গেলে বিমানকে বড় লোকসানে পড়তে হবে। কারণ, উড়োজাহাজের ভাড়া বেশি হওয়ায় ফ্লাইট পরিচালন খরচ অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হবে। এ বিষয়ে কাইল হেয়্যুড বলেন, ভাড়া করা দুটি ড্যাশ-৮ জাহাজের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে ফ্লাইট পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে বিমানের লাভ না লোকসান হবে, সে বিষয়ে কাইল কিছু বলেননি। প্রসঙ্গত, আগামী ৬ এপ্রিল থেকে বিমান অভ্যন্তরীণ সব গন্তব্যে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, রাজশাহী, সৈয়দপুর ও বরিশাল) ফ্লাইট চালুর ঘোষণা দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment