বনভূমি রক্ষায় প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও জনসম্পৃক্ততা। বন্দোবস্ত প্রথা বাতিল করে বনের জমি বনের, খালের জমি খালের, নদীর জমি নদীর থাকবে—এ রকম আইন করতে হবে। বনভূমি দখলকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ না করলে বন রক্ষা করা কঠিন হবে। প্রথম আলোর উদ্যোগে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশে বন ব্যবস্থাপনা: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ অভিমত দেন। ২১
মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবস সামনে রেখে আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতায় ছিল বন অধিদপ্তর ও জার্মানির উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জিআইজেড। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন। গোলটেবিল আলোচনায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মিহির কান্তি মজুমদার বন্দোবস্ত দেওয়ার বিষয়টিকে আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কমন প্রপার্টি কনজারভেশন অ্যাক্ট’ করতে হবে, যেন কেউ বন বা জলাশয়ের জমি দখল করতে না পারে। প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী বলেন, মুষ্টিমেয় ভূমিদস্যু বিভিন্নভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে। এই প্রশ্রয় যাতে না পায়, সে জন্য গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি বলেন, জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ বনের কাছে গেছে, বনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। এ কারণে বন ব্যাপক হারে নিধন হয়েছে। তিনি সামাজিক বনায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে এ বিষয়ে তাঁদের সুফল পাওয়ার বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। যারা বনভূমি দখল করছে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ না করলে বন রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মত দেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) এদেশীয় প্রতিনিধি ও সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বন ধ্বংস হচ্ছে এটা লুকানোর কিছু নেই। বন অপরাধ দমন বা বন সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগ সরকারিভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে অপরাধটি যখন সামাজিক ব্যাধি হয়ে যায়, তখন এককভাবে কোনো সংস্থার পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদেরও প্রতিশ্রুতি দরকার। শালবনসহ বিভিন্ন বন দখলের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বনের নির্ধারিত সীমানা রয়েছে, তা পুনঃ চিহ্নিত করে মাঠপর্যায়ে সবার গোচরে আনা প্রয়োজন। বন বিভাগের বিভিন্ন ইতিবাচক কার্যক্রম তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও বন বিভাগ দেশের প্রাচীন বিভাগ। বন নিয়ে পরিকল্পনারও দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। কিন্তু বেশির ভাগ পরিকল্পনা করা হয়েছে মানুষকে বাদ দিয়ে। ২০ বছর ধরে মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হচ্ছে। তবে এখনো দীর্ঘ পথ বাকি। এ ছাড়া পরিকল্পনা করা হলেও সেটা বাস্তবায়নের জন্য যে সম্পদ ও জনবল দরকার, তা কখনো ছিল না। বর্তমানে বন বিভাগের সার্বিক ভাবমূর্তির সমস্যাকে তিনি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জাতীয় পর্যায়ে বনের অগ্রাধিকার একেবারেই তলানিতে। তাই এটাকে অন্তত কীভাবে অগ্রাধিকারের মধ্যম পর্যায়েও নেওয়া যায়, সেটা ভাবতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বনায়নকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জিআইজেডের উপদেষ্টা গেরিট কোয়ালিটজ বলেন, বন বিভাগের সহযোগিতায় তাঁরা তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। বন বিভাগের উপপ্রধান বন সংরক্ষক আকবর হোসেন বলেন, যখন দেখা গেল মানুষকে সম্পৃক্ত করলে ভালো হয়, তখন সরকারি জায়গায় সামাজিক বনায়ন শুরু করা হয়। প্রথমে কেউ সরকারি জায়গায় গাছ লাগালে তাঁকে ৪৫ শতাংশ দেওয়া হতো ও ৪৫ শতাংশ বন বিভাগ পেত এবং বাকি ১০ শতাংশ পরবর্তী বনায়ন করার জন্য রাখা হয়। কিন্তু এখন যিনি বনায়ন করবেন, তাঁকে ৭৫ শতাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বন বিভাগের জনবলসংকট সাংঘাতিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাংগঠনিক কাঠামো করার তিন বছর হয়ে গেলেও কাজ হচ্ছে না। সহকারী প্রধান বন সংরক্ষক অসিত রঞ্জন পাল বলেন, তাঁরা জনগণকে নিয়ে পথচলা শুরু করেছেন। এ ক্ষেত্রে সুফলও পাচ্ছেন। তিনি মধুপুর বনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এই বনে ৫৭টি গ্রাম ছিল। ওই সব গ্রামের মানুষ জ্বালানির জন্য গাছ কাটত। বছরে প্রায় ছয় লাখ গাছ কাটা হতো। এরপর ৭০০ জন গাছচোরকে বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের নির্ধারিত পোশাক পরিয়ে এখন বন রক্ষা করা হচ্ছে। ফলে গত চার বছরে কোনো গাছ চুরি করে কাটা হচ্ছে না। মোদ্দাকথা হলো, জনগণকে বাদ দিয়ে বন ব্যবস্থাপনা করা যাবে না। বন নিয়ে যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেন, তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য অনেক সময় পুরোটা পান না বলে মত দেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশের প্রতিনিধি মাইকেল টমাস রবসন। প্রাপ্যটা ঠিকমতো দেওয়ার পাশাপাশি তিনি টেকসই খাদ্যনিরাপত্তার ওপর জোর দেন। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, বনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বনকে শুধু রাজস্ব আয়ের উপায় না দেখে ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইতিবাচকভাবে এগোতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বন্য প্রাণীবান্ধব। কিন্তু বন ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনি আরও কয়েকটি এলাকাকে সংরক্ষিত বনায়ন করার পরামর্শ দেন। বন সহ-ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পরামর্শ দেন জিআইজেডের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আব্রাহাম হোসেন।
No comments:
Post a Comment