যাত্রীঠাসা বাসটি রাতের আঁধারে চলছিল বেপরোয়া গতিতে। আতঙ্কে যাত্রীরা চালককে সাবধানে গাড়ি চালানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু চালক গায়ে লাগাননি। সেভাবেই চালিয়ে যান। একগুঁয়েমির একপর্যায়ে শক্ত গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে বাসটির। মুহূর্তে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঝরে যায় ২৫টি নিরীহ প্রাণ। পুলিশ বলছে আরও ভয়াবহ কথা। চালক নাকি গাড়ি চালাতে গিয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। তবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চালক ও সহকারী বলেন, যাত্রীবেশী ডাকাতদের
কবলে পড়াতেই ঘটে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ফরিদপুরের ভাঙ্গা পৌর এলাকার কৈডুবি সদরদী এলাকায় গত বুধবার দিবাগত রাত সোয়া একটার দিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার শিকার সোনার তরী পরিবহনের ওই বাস ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া যাচ্ছিল। রাত নয়টার দিকে রাজধানীর গাবতলী থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসে যাত্রী হয়ে উঠেছিলেন অর্ধশতাধিক লোক। বাসটি ওই এলাকায় যাওয়ার পর চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় সেটি মহাসড়কের বাঁ পাশে একটি কড়ইগাছে আঘাত করে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৯ জন। আহত হন অন্তত ২২ জন। আহত ব্যক্তিদের প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনজন মারা যান। পরে আহত ১৯ জনের মধ্যে ১৮ জনকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে আরও তিনজনের মৃত্যু হয় বলে জানান হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক গণপতি বিশ্বাস। স্থানীয় সদরদীর লাল মিয়া জানান, রাতে প্রচণ্ড শব্দ শুনে তিনি বাড়ি থেকে ছুটে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, মহাসড়কে দুমড়ে-মুচড়ে রয়েছে একটি বাস। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিরা আর্তনাদ করছেন। এলাকাবাসী ও পাশের একটি আনসার ক্যাম্পের সদস্যরা এসে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। পরে ফরিদপুর ও ভাঙ্গার দমকল বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার সূর্য বেগম (৭০), আকলি বেগম (৬০), হেলাল ফকির (২৮), মাহমুদুল হাসান মিঠু (২০), জুয়েল (৩৪) ও রিপন উকিল (৩৫); খেপুপাড়ার শাহিন (২৫), আছমা বেগম (২৭) ও আবু বক্কর (৩০); গলাচিপার সোহাগ (৩০); সদর উপজেলার রেজাউল (২০), নাজমা বেগম (৩০) ও কবির ফকির (৫০); বাউফল উপজেলার সুমন মাহাবুব (২৮); বরগুনার আমতলী উপজেলার রাবেয়া বেগম (৭০), টুটুল হাওলাদার (৪৫) ও রতন সান্নাল (৩০); তালতলী উপজেলার বারেক হাওলাদার (৪০); বরিশাল সদর উপজেলার শাহরিয়ার (২৮); বানারীপাড়া উপজেলার আফজাল হোসেন (৪০); মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার বাহাদুর (২৭); যশোর সদর উপজেলার মনিরুল (৩৫); ফরিদপুর সদর উপজেলার মোবারক হোসেন (৩৩); দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার মামুনুর রশীদ (৩৫) এবং বাসের সুপারভাইজার গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার শফিকুল শেখ (২৮)। নিহত ২৫ জনের লাশই তাঁদের স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মোজাম্মেল হোসেন। যে কারণে এই দুর্ঘটনা: দুর্ঘটনাকবলিত বাসের যাত্রী রুবি আক্তার (১৮) বলেন, ‘চালক গাবতলী থেকে ছাড়ার পর থেকেই বাসটিকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চালাচ্ছিল। এ ব্যাপারে তাকে যাত্রীরা বারবার সতর্ক করলেও সে তাতে কান দেয়নি।’ একই অভিযোগ করেন আহত যাত্রী মো. সিদ্দিকুর রহমান (৩২) ও মো. জাকির হোসেন (৩০)। হাইওয়ে পুলিশ মাদারীপুর অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার বেলাল হোসেনের ভাষ্য, ধারণা করা হচ্ছে, বাসচালক ঘুমিয়ে পড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাসচালক মো. জাকির হোসেন (৪০) ও তাঁর সহকারী মো. মন্টু খান (৩৫) দাবি করেন, যাত্রীবেশী ডাকাতেরা হামলা করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। জাকিরের ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেলেও অক্ষত আছেন মন্টু। জাকিরের বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় ও মন্টুর বরিশাল সদর উপজেলায়। জাকির দাবি করেন, রাত একটার দিকে ভাঙ্গা থেকে এক কিলোমিটার আগে কয়েকজন ডাকাত তাঁকে মারধর করে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ফরিদপুরের পুলিশ সুপার জামিল হাসান বলেন, ‘চালক মিথ্যা দাবি করছেন। আহত যেসব যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের সবারই বক্তব্য, বেপরোয়া গতিতে চালাতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’ হয়রানির অভিযোগ: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টাকাপয়সা ও মুঠোফোন ছিনতাই এবং হাসপাতালসংলগ্ন ফার্মেসিগুলোতে ওষুধের বাড়তি মূল্য রাখাসহ নানা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন আহত ব্যক্তিদের কয়েকজন স্বজন। পরে পুলিশ ফার্মেসিগুলোতে অভিযান চালিয়ে এক মালিক ও এক কর্মচারীকে আটক করে। তদন্ত কমিটি গঠন: দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়ে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুর রশীদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি। মাদারীপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার সাজিদ হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের অপর কমিটি। কমিটিগুলোকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। আর্থিক সহায়তা: নিহত ব্যক্তিদের দাফন ও সৎকারে তাঁদের পরিবারপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া প্রত্যেক আহত রোগীর চিকিৎসা খরচ জেলা প্রশাসন বহন করবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মা-ছেলের মৃত্যু: দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন বরগুনার আমতলী উপজেলার পূজাখোলা গ্রামের রাবেয়া বেগম (৭৫) ও সোলায়মান হাওলাদার (৪০) পরস্পর মা-ছেলে। তাঁদের মৃত্যুতে গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সোলায়মান তাঁর মাকে চিকিৎসার জন্য ১৫ দিন আগে ঢাকায় নিয়ে যান। চিকিৎসা শেষে বুধবার রাতে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে কুয়াকাটাগামী ওই বাসটিতে ওঠেন। পরে সেটি দুর্ঘটনায় পড়ে দুজনেই মারা যান। গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁদের লাশ গ্রামে পৌঁছায়। হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি শোক: মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় গতকাল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গভীর শোক জানিয়েছেন। পৃথক বার্তায় তাঁরা এই শোক প্রকাশের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানান। {প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, বরগুনা এবং ফরিদপুর ও বরিশাল অফিস}
No comments:
Post a Comment