Sunday, April 26, 2015

ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত ১৫৩৫:যুগান্তর

ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল ৫ দেশ। নেপালের লামজুংয়ে বাংলাদেশ সময় দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এই ভূমিকম্প হয়। এতে রাত ৮টা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩৫-এ। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। হতাহতের এ সংখ্যা ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। নেপাল ছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান এবং তিব্বতের বিস্তীর্ণ এলাকা ভূমিকম্পের ধাক্কায় কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্পের আঁচড় লাগে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত হিমালয়েও। এত
ে বরফ ধসের সৃষ্টি হয়েছে। এসব দেশে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। অসংখ্য ভবন ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে নেপাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন অসংখ্য মানুষ। উদ্ধার তৎপরতায় নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস টেলিফোনে নিশ্চিত করেছেন দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা সুস্থ আছেন। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমদ আনসারী যুগান্তরকে বলেন, গত ৮১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প এটি। এর আগে ১৯৩৪ সালে এ ধরনের একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। সেটির নাম ছিল বিহার-নেপাল ভূমিকম্প। এর মাত্রা ছিল শনিবারেরটির চেয়েও কম, রিখটার স্কেলে ৭.১। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক সোসাইটি (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূভাগের ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়া প্লেটের মধ্যকার সংঘর্ষের কারণে এ কম্পের সৃষ্টি হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভূ-উপরিভাগ থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার মাটির গভীরে। সংস্থাটি ভূকম্পটির নাম দিয়েছে ‘নেপাল ভূমিকম্প’। তারা আরও জানায়, প্রথম ভূমিকম্পের পর পরবর্তী সোয়া ৩ ঘণ্টার মধ্যে একই এলাকায় আরও ১৫ বার কম্পনের সৃষ্টি হয়। এগুলোর মধ্যে রিখটার স্কেলে ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল সবচেয়ে ছোট। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ৮১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এবং পোখারা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে। মূল কেন্দ্রস্থলটি লামজুং শহর থেকে ২৯ কিলোমিটার পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। সেখান থেকে ঢাকার দূরত্ব ৭৪৫ কিলোমিটার। ভূকম্পনটি নেপাল ছাড়া ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান এবং তিব্বতেও অনুভূত হয়। এর মধ্যে নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ ও তিব্বতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ভুটানে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। নেপালে প্রাণ হারিয়েছেন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪৫৭ জন। এর মধ্যে রাত ৮টা পর্যন্ত নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ৫২৪ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া ভারতে ৪৫, বাংলাদেশে ৩, তিব্বতে ১২ এবং হিমালয় শৃঙ্গে ১৮ পর্বতারোহীর প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। সেখানে আটকা পড়েছেন ৮ শতাধিক অভিযাত্রী। নেপালে ভারতের দূতাবাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে এক কর্মকর্তার স্ত্রী মারা যান। ভূমিকম্পে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বার্তা সংস্থা এএফপি ও রয়টার্স জানায় (রাত ৮টার দিকে), ৮১ বছরের মধ্যে ভয়াবহ এ কম্পনে কাঠমান্ডুতেই ৫২৪ জন মারা গেছেন। কাঠমান্ডুর ১৪ তলা ধারাহারা ভবনটিও ধসে পড়েছে। ১৮৩২ সালে নির্মিত এ ভবনটি কাঠমান্ডুর অন্যতম প্রধান পর্যটনের স্থান। ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে ইতিমধ্যে ১৮০টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখানে আরও অনেকে আটকা রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পাওয়া কাঠমান্ডুর দরবার স্কয়ার সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও কাঠমান্ডুর কাছাকাছি ভক্তপুরে মারা গেছেন আরও ৪৩ জন। কাঠমান্ডুর একটি পার্কে ভাস্কর্য ভেঙে পড়লে এক মেয়ে শিশু মারা যায়। উদ্ধার হওয়া হতাহতদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আটকাপড়াদের উদ্ধারে চেষ্টা চলছে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, কাঠমান্ডুতে প্রচণ্ড আঘাত হানলেও দেশটির শহর কীর্তিপুর, নাগারকোট ও ভরতপুর অতি তীব্র, পোখরা তীব্র এবং গোরখপুর ও মুজফপুর মধ্যম বেগে কেঁপে ওঠে। নেপালের তথ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে পড়েছি। এ অবস্থা মোকাবেলায় যাদের বেশি জ্ঞান এবং সরঞ্জাম রয়েছে তাদের সহায়তা জরুরিভিত্তিতে আমাদের প্রয়োজন। কম্পনের জেরে এদিন দেশটির অধিকাংশ স্থান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ঘটনার পর কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দা প্রচণ্ড সুয়াল বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু ভবন ধসে পড়েছে। শত বছরের পুরনো মন্দিরও এদিন ধসে পড়ে। ভূমিকম্পের সময় আমি বহু মানুষকে ভয়ে রাস্তায় নামতে দেখেছি। ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রীয় বেতারে নাগরিকদের বাসস্থানের বাইরে অবস্থান করার পরামর্শ দেয়া হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কাঠমান্ডুতে পুরনো ভবন ও সংকীর্ণ রাস্তার কারণে এ আশংকা বেড়েছে। নেপালের এ ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শনিবার দুই দফা তীব্র ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে বলে সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী এ ভূমিকম্পে দেশব্যাপী আতংক ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন এলাকার মানুষ আতংকে বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসেন। ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার খবরে বিভিন্ন ভবন থেকে নামতে গিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে মোট তিনজন নিহত আর ৯ শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতের বেশিরভাগই গার্মেন্টকর্মী। আতংকে হুড়োহুড়ি করে ভবন থেকে নামতে গিয়ে তারা আহত হন। ঢাকায় মোট ১৫টি বহুতল ভবনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৭টি হেলে পড়েছে। ৬টিতে ফাটল ধরেছে। ঢাকার বাইরেও অসংখ্য ভবন হেলে পড়া ও ফাটলের খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে একজন বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার মোরশেদা বেগম (৪৮)। তিনি দেয়াল চাপায় নিহত হন। বাকি দু’জন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের পরিনা আক্তার ও পাবনার ঈশ্বরদীর রোকেয়া বেগম ইতি (৬৫)। একজন ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ১৮ পর্বতারোহীর মৃত্যু : ভূমিকম্পের কারণে হিমালয়ে জমাট বাঁধা বরফে ফাটল ধরে। এতে এভারেস্ট পর্বতে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিদেশী পর্যটক ও শেরপারা রয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও কয়েকজন। দানিয়েল মাজুর নামের পর্বতারোহী বলেন, এভারেস্টের বেসক্যাম্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের দল আটকে গেছে। টুইটার পেজে তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। ভারতে নিহত ৪৫ : দেশটির বেসরকারি একটি টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, নেপালের পর শক্তিশালী ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে। এতে ধসে ও হেলে পড়ে অনেক ভবন। দিল্লি ও আশপাশের এলাকায় এক মিনিটেরও বেশি সময় ধরে কম্পন অনুভূত হয়। এ সময় লোকজন ভয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এছাড়াও ভারতের মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল, আসাম, ঝাড়খন্ড, পাটনা, রাজস্থান, ওড়িষ্যা, লক্ষ্ণৌ, সিকিম, কলকাতা, জয়পুর, চন্ডিগড়সহ কয়েকটি স্থানে ভূমিকম্পের খবর পাওয়া গেছে। শনিবার দুপুরে এ ভূমিকম্পে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দেশটিতে ৪৫ জনের মতো নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিহারে মারা গেছেন ১৪ জন। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এদিকে ভূমিকম্পে ভয়ে দৌড়ে আত্মরক্ষার সময় পশ্চিমবঙ্গের দুটি স্কুলের অন্তত ৪০ জন শিশু আহত হয়েছে। অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের বারাবানকি শহরে ভূমিকম্পে একটি বাড়ি ধসে এক নারী ও তার শিশুকন্যা নিহত হয়েছে। কেঁপে ওঠে চীনের তিব্বত এবং ব্রিটেন। তিব্বতে পাঁচজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কম্পনের কারণে কলকাতার পাতাল রেল ১৫ মিনিট বন্ধ ছিল। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. আনসারী বলেন, নিঃসন্দেহে এটি শক্তিশালী ভূমিকম্প। এবারেরটিতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার প্রধান কারণ এটার উৎপত্তিস্থল মাটির বেশি গভীরে ছিল না। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল মাটির যত গভীরে হয়, তার অনুভব এবং আওতা বেশি হয়। তিনি মনে করেন, বড় তীব্রতার হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের ভূমিকম্পে আমাদের দেশে বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা কম এ কারণে যে, আমাদের দেশের ভেতরে কিছু ভূমিকম্পপ্রবণ ফল্ট (ভূ-চ্যুতি বা এলাকা) রয়েছে, সেখানে এ ঘটনা ঘটেনি। এটা এলাকার বাইরে নেপালে হিমালিয়ান এলাকার কাছাকাছি। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, যেহেতু বড় ধরনের একটি ভূমিকম্প হয়ে গেছে, তাই প্লেট সেট হওয়ার জন্য আগামী ৩ বছর একই এলাকায় আরও অসংখ্য ভূমিকম্প হতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, ‘প্রথম দফায় দুপুর ১২টা ১১টা মিনিটে ভূকম্পন অনুভূত হয়। দ্বিতীয়বার ভূকম্পন অনুভূত হয় ১২টা ৪৫ মিনিটে।’ তিনি আরও জানান, কত মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, তা বাংলাদেশে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এ কারণে উৎপত্তিস্থলের মাত্রাটিই আমরা বলি। তবে সারা দেশেই কম্পন অনুভূত হয়েছে। কম্পনটা বেশ বড় হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, উৎপত্তিস্থল থেকে ক্রমান্বয়ে কম্পন যত দূরে যাবে মাত্রা তত কমবে।  

No comments:

Post a Comment