Sunday, April 26, 2015

বিচারব্যবস্থার সংস্কার ও আইন সহায়তা বৃদ্ধির সুপারিশ:প্রথম অালো

টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক কৃষক জগন্নাথ। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এক একরের মতো জমিই তাঁর পরিবারের জীবিকার উৎস। কিন্তু পাশের এক প্রভাবশালী বড় খামার করতে ওই জমিটুকু কিনতে চাইলেন। জগন্নাথ সে জমি বেচবেন না। শেষ পর্যন্ত হুমকি—হয় বিক্রি করো, না হলে অন্য ব্যবস্থা করা হবে। জগন্নাথ এখন কোথায়, কার কাছে বিচার চাইবেন। আদালতে বিচার চাওয়ার প্রক্রিয়া তিনি জানেন না। তাতে খরচ সম্পর্কেও তাঁর ধারণা নেই।
তাহলে তাঁর এখন কী হবে? ‘একসেস টু জাস্টিস: জুডিশিয়াল রিমিডি’ শীর্ষক সেমিনারে এই ঘটনা ও প্রশ্নটি উত্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রফিকুল ইসলাম মেহেদি। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল শনিবার সকালে মাসিক লিগ্যাল এইড আয়োজিত এই সেমিনারে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন বিচারপতি, কয়েকজন জেলা জজ ও আইনজীবী জগন্নাথের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কী করে বিনা মূল্যে সরকারি আইন সহায়তা পেতে পারেন; সহায়তা পেতে কোথায় যেতে হবে তা না জানলে সহায়তা যাঁরা দেবেন তাঁরা জগন্নাথের কাছে যেতে পারেন কি না; গ্রাম আদালতে বিষয়টির ফয়সালা হতে পারে কি না—এসবই ছিল তাঁদের আলোচনার বিষয়। জগন্নাথের মতো অবস্থা অসংখ্য সাধারণ মানুষের। এসব ক্ষেত্রে যদিও সরকারের আইন সহায়তা কর্মসূচি (লিগ্যাল এইড প্রোগ্রাম) রয়েছে, কিন্তু এর অবস্থা যে খুব ভালো নয় সে কথাও সেমিনারের আলোচনায় উঠে আসে। সেমিনারে বিচারব্যবস্থার সংস্কার ও আইন সহায়তা সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হয়। এই আলোচনার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সেমিনারে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষও বিচার চাওয়া ও পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বাধা ও সমস্যায় পড়ে। বিশেষ করে দরিদ্র, নারী, শিশু, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য কারণে অক্ষম জনগোষ্ঠী এই সমস্যার মুখোমুখি হয় বেশি। তাদের এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে বিচারব্যবস্থা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর যে সক্ষমতা থাকা দরকার তা নেই। এ ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট বাধা হচ্ছে মামলার ব্যয়, দুর্নীতি, অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার এবং বিচার পাওয়ার আইনি অধিকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব। প্রধান বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের আইন সহায়তা দেয় সবার জন্য বিচার পাওয়ার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে। এই সহায়তা কোনো দাতব্য বিষয় নয়। এটা মানুষের অধিকার। বাংলাদেশে এ অধিকার নিশ্চিত করতে হলে বিচারব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার মামলা ব্যবস্থাপনা ও আদালত প্রশাসন বিষয়ে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার কাঁধে প্রায় ৩০ লাখ অনিষ্পন্ন মামলার বোঝা চেপে আছে। এর প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি বিরোধসংক্রান্ত মামলা। দীর্ঘকাল ধরে এসব মামলা চলাও বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের বঞ্চনা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলার ব্যয় অত্যধিক। আদালতের প্রক্রিয়াও দীর্ঘমেয়াদি। মামলা নিষ্পত্তিতে আইনজীবীদের অনীহা লক্ষ করা যায়। বেলা দুইটার পর আদালতে কোনো আইনজীবীকে পাওয়া যায় না। আবার জোটবদ্ধ হয়ে কোনো আদালত বা বিচারকের বিরোধিতা করা কিংবা আদালত বর্জনের প্রবণতাও আছে। প্রধান বিচারপতি এসব বিষয়ে আইনজীবীদের সহায়তা কামনা করেন। একইসঙ্গে তিনি গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার। আমলাতান্ত্রিক কারণেও মামলা বিলম্বিত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত ফাইল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আটকে থাকে। আইন মন্ত্রণালয়ে বিচার বিভাগের কোনো কর্মকর্তাকে প্রেষণে পাঠালে তিনি মনে হয় যেন আরও বেশি আমলাতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন। তা ছাড়া, বিচারব্যবস্থায় জনবলের অভাব আছে। অধস্তন আদালতগুলোয় সহকারী জজ থেকে জেলা জজ পর্যন্ত মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১ হাজার ৬৫৫টি। এর মধ্যে বর্তমানে ৪৫৭টি পদ শূন্য। সবচেয়ে বেশি শূন্য পদ যুগ্ম জেলা জজ ও সমপর্যায়ে, ২৭৬টির মধ্যে ১৩০টি শূন্য। অথচ বেশির ভাগ মামলা নিষ্পত্তি এই পর্যায়েই হওয়ার কথা। প্রধান বিচারপতি বলেন, দেশে মোট ৪২টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এসব ট্রাইব্যুনালের জন্য যুগ্ম জেলা জজ মর্যাদার পদ সৃষ্টি করা হয়েছে ১৩টি। পদায়ন করা হয়েছে ১২টিতে। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে ৬১ জেলায় মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১ লাখ ১৯ হাজার ৪২৯টি। এই মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য কোনো বিচারকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে অর্থঋণ আদালতের মতো প্রতিষ্ঠান ও গ্রাম আদালতকে আরও ক্ষমতা দিয়ে কার্যকর করার অভিমত দেন। তিনি বলেন, দেশের বিচারব্যবস্থা একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিচারব্যবস্থার সব পর্যায়ে কর্মরতরা সক্রিয় ভূমিকা রাখলে এটি ভারসাম্যপূর্ণ একটি বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে যেতে পারে। সেমিনারে নির্ধারিত আলোচক ছিলেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি নাইমা হায়দার। তাঁরা বিচারব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কারের (থরো ওভারহলিং) প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সেমিনারের মুক্ত আলোচনা পর্বে বিচারপতি আবদুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, জেলা জজ আতোয়ার রহমান, গোলাম মর্তুজা মজুমদার প্রমুখ অংশ নেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার সাধারণ মানুষের জন্য আইন সহায়তার বিস্তার ঘটাতে কী কী করা হচ্ছে তার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা আইন সহায়তার কাজে অংশ নিতে সাধারণত রাজি হন না। ফলে মানসম্পন্ন আইন সহায়তা পাওয়া নিশ্চিত করা যায় না। এ ব্যাপারে জনগণের সচেতনতাও কম। আইনজীবী সমিতিগুলোর ভূমিকাও হতাশাজনক। সুপ্রিম কোর্টসহ প্রতিটি আদালতে ‘হেল্প ডেস্ক’ থাকা অপরিহার্য। আদালত অঙ্গনে শৌচাগার, বসার স্থান, ভালো ব্যবহার—সব কিছুরই অভাব আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অন্য আলোচকেরা বলেন, গ্রাম আদালত ভালোভাবে চলছে না। এই আদালতের প্রতি মানুষের আস্থারও অভাব রয়েছে। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন মাসিক লিগ্যাল এইডের সম্পাদক খাজা গোলাম মোর্শেদ।

No comments:

Post a Comment