Wednesday, May 6, 2015

ছুটি মেলেনি আটজনের:প্রথম অালো

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের একটি ওয়ার্ডের একেবারে কোনার দিকের বিছানায় বসে ছিলেন সালাউদ্দিন ভূঁইয়া। মুখমণ্ডল কুঁচকানো, হাত বেঁকে গেছে, মুখ হাঁ করতে পারেন না, সব সময় খোলা থাকে ডান চোখটি। মাতুয়াইলের কাঠেরপুল এলাকায় অবরোধ-হরতালে পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে তিন মাস ধরে তিনি চিকিৎসাধীন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তাঁর ছুটি মেলেনি। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিত
ে গত ৬ জানুয়ারি থেকে হরতাল-অবরোধের সময় সহিংসতায় নিহত হন ১৩১ জন। এর মধ্যে পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ৭৫ জন। এ সময় দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন মোট ১৮২ জন। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন ২১ জন। এখন ভর্তি আছেন আটজন। দেশের ১৪টি মেডিকেল কলেজে বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার চেষ্টায় অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আমরা চিকিৎসা-পরবর্তী নির্দেশনা (ফলোআপ) মেনে চলার জন্য বারবার বলেছি। অনেকেই আসছেন। যাঁরা আছেন, আশা করি তাঁরাও অস্ত্রোপচার শেষে বাড়ি ফিরবেন। একেকজনের কয়েক দফা করে অস্ত্রোপচার লাগছে।’ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সালাউদ্দিনের দুই হাতই বেঁকে শক্ত হয়ে গেছে। সেখানে অস্ত্রোপচার লাগবে। চোখের অবস্থা আরও ভয়াবহ। দেখলে মনে হয়, ডান চোখটা এখনি বেরিয়ে আসবে। ডান চোখটা বন্ধও হয় না। সালাউদ্দিন যে জায়গাটায় বসে ছিলেন, সেখান থেকে একবার গোটা ওয়ার্ডে চোখ বোলালে বোঝা যায়, হরতাল-অবরোধের আগুন কী করে পাল্টে দিয়েছে একেকটি জীবন। মাতুয়াইলের কাঠেরপুলে পেট্রলবোমা হামলার সময় বাসে সালাউদ্দিনের সহযাত্রী ছিলেন খোকন। খোকনের মুখমণ্ডল ও শ্বাসতন্ত্রসহ পুড়ে গিয়েছিল শরীরের ২০ শতাংশ। দ্রুতই সেরে উঠছিলেন খোকন। হঠাৎই আবার সংক্রমণ দেখা দেয় তাঁর শরীরে। কবজি থেকে তাঁর হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। এখনো দগদগে ঘা শরীরের কোথাও কোথাও। গতকালও নার্সকে দেখা গেল পায়ে ইনজেকশন দিতে। কবে খোকন হাসপাতাল ছাড়তে পারবেন, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন চিকিৎসকেরা। খোকনের মতো শরীরে দগদগে ঘা নিয়ে সেরে ওঠার অপেক্ষা করছেন ট্রাকচালক ইসমাইল হোসেন, ডিম ব্যবসায়ী মনু মিয়া, সিলেটের গাড়ির কারিগর নিরঞ্জন, নারায়ণগঞ্জের ফেরিওয়ালা শফিকুল ও রংপুরের ট্রাকচালক রিয়াজ। নারায়ণগঞ্জের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ শফিকুল খই-মুড়ির মতো খাবার ফেরি করে বিক্রি করতেন। কক্সবাজার থেকে বাসে ফেরার পথে কুমিল্লায় পেট্রলবোমা হামলার শিকার হন ৩ ফেব্রুয়ারি। শফিকুলের বুক-হাত এখনো ব্যান্ডেজে মোড়া। ঠিকমতো নড়াচড়া করতে পারেন না। বিছানার ওপর একটা পিঁড়ি পেতে তার ওপর বসে খাচ্ছিলেন। ঝুঁকে যে ভাতের থালাটার দিকে তাকাবেন, সেই অবস্থা নেই। তবে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন নিরঞ্জন। পেশায় গাড়ির কারিগর। গত ২৩ জানুয়ারি গাড়ি সারানোর পর পরীক্ষা করে দেখছিলেন। তখনই তাঁর ওপর হামলা হয়। মাস খানেক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ছিলেন। একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে নিরঞ্জনের। গতকাল নিরঞ্জনের বাবা জানিয়েছেন, ছেলের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। হরতালের আগুনে পুড়ে কয়েক মাস ধরে যাঁরা বার্ন ইউনিটে আছেন, তাঁদের অনেকেরই স্ত্রী-সন্তান সঙ্গে আছেন। কারও কারও একটার বেশি সন্তান। তাঁরা দিনের পর দিন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকছেন। স্কুলগুলোয় প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা দিতে পারেনি সালাউদ্দিন ভূঁইয়ার দুটি ছেলের একটিও। সালাউদ্দিনের স্ত্রী ঊর্মি আক্তার বলছিলেন, ‘আমার বাচ্চারা ৯০-এর নিচে নম্বর পায় না। কিন্তু স্বামীকে বাঁচাতে হলে ছাড় তো দিতেই হবে। ওদের ফরিদপুরে বোনের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।’ রংপুরের ট্রাকচালক রিয়াজের সপ্তম ও তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া দুই কন্যা রাফিয়া আর রিয়া। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওদের নাম রেখেছেন। মেয়েদের দেখতে খুব মন চায়—এটুকু বলেই রিয়াজ কান্না চাপলেন।

No comments:

Post a Comment