Friday, May 15, 2015

আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর বরাদ্দে বড় অনিয়ম:যুগান্তর

সাতক্ষীরা জেলায় আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সরকারি ঘর বরাদ্দে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। যাদের নামে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রকৃতপক্ষে তাদের অনেকেই ঘর পাওয়ার যোগ্য নয়। জেলা পরিষদে কর্মরত ব্যক্তি, স্থানীয় ইউপি সদস্যের ছেলে, চাকরিজীবী, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দ হয়েছে এসব ঘর। অনেকে পিতা-পুত্র অথবা দুই ভাই একই সঙ্গে বরাদ্দ পেয়েছেন। অথচ ভূমিহীন, অসহায়, ক্ষতিগ্রস্ত, প্রকৃতপক্ষে যারা ঘর বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্
য তারা বঞ্চিত হয়েছেন। এসব অনিয়মের পেছনে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা কাজ করেছে বলে দাবি অনেকের। এক রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে যাদের নামে ঘর বরাদ্দ হয়েছে প্রকৃতপক্ষে তারা তা পাওয়ার যোগ্য কিনা তা তদন্তে গত বছরের ২৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। সে আনুযায়ী সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক ও সাতক্ষীরা এক এবং চার নম্বর আসনের এমপি তদন্ত করে হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। ওই প্রতিবেদনে ৩৫৩ জনের মধ্যে ৪৫ জন ঘর পাওয়ার যোগ্য নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তদন্ত প্রতিবেদনে যারা ঘর পাওয়ার যোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যেও অনেকে ঘর পাওয়ার যোগ্য নয় বলে দাবি করেছেন রিট মামলার আইনজীবী সত্য রঞ্জন মণ্ডল। এই আইনজীবী যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের রঘুনাথপুর গ্রামের দু’জন উপকারভোগী মো. আনিছুর রহমান গাজী ও মো. হাফিজুর রহমান গাজীর বিষয়ে তদন্ত করে তারা ঘর পাওয়ার যোগ্য বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এরা দু’জনেই মো. আবদুর রশিদ গাজীর ছেলে। আমি নিজে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি, আবদুর রশিদ গাজীর তিন ছেলেরই ইটের তৈরি পাকা বাড়ি রয়েছে। এরা ছাড়াও তদন্ত প্রতিবেদনে যারা ঘর পাওয়ার যোগ্য বলে মন্তব্য করা হয়েছে, তাদের অনেকেই ঘর বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য নয়।’ ‘সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় ‘দুস্থ-গরিব, আর্থিক অসচ্ছল ও ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীন ব্যক্তিদের অনুকূলে ৪০০ ঘর বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী একই বছরের ২ জুুলাই ঘর নির্মাণের টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি জারি করে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ। এ ঘর বরাদ্দের বিষয়ে সাতক্ষীরার জেলা পরিষদ থেকে একটি তালিকা তৈরি করা হলে তাতে অনিয়মের অভিযোগে হাফিজুর রহমানসহ অন্যরা বাদী হয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট হাইকোর্ট প্রকৃতপক্ষে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীনদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেন। কিন্তু সেটা না করে আগের তালিকা অনুযায়ীই ঘর বরাদ্দের কার্যক্রম চলতে থাকে। এ অবস্থায় হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি না করেই ঘর বরাদ্দের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালের ১৪ জুলাই হাইকোর্টে আরও একটি রিট হয়। এ রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট নির্মাণাধীন ঘর হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে গেলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন। পাশাপাশি হাইকোর্টের মূল মামলার নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এ অবস্থায় এক সম্পূরক আবেদনে গত বছরের ২৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট ৩৫৩টি বাড়ি যাদের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তারা তা পাওয়ার যোগ্য কিনা তা তদন্ত করে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা-১ আসনের এমপি ও ৪ আসনের এমপিকে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মো. ইলিয়াস হোসেন ও মো. হবিবার রহমান সম্পর্কে পিতা-পুত্র। তারা যৌথ পরিবারে বাস করেন। তাদের দু’জনের নামেই ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বাড়িতে ইট এবং টিনের চার কক্ষবিশিষ্ট ঘর এবং হবিবার রহমানের নামে ৯০ শতাংশ জমি রয়েছে। তাদের দু’জন ঘর বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাতক্ষীরা সদর থানার কামার বায়সা গ্রামের মো. আবদুর রশিদ সাতক্ষীরা জেলা পরিষদে কর্মরত। গ্রামে তার ইটের তৈরি পাকা বাড়ি রয়েছে। তিনি সাতক্ষীরা শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তাছাড়া সরকারিভাবে তার এক তলাবিশিষ্ট একটি নবনির্মিত দালান ঘর তৈরি আছে। এই ব্যক্তি ঘর পাওয়ার অনুপযুক্ত বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। সাতক্ষীরার তালা থানায় বরাদ্দকৃত দুটি ঘরের ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোছাঃ সাজেদা বেগমের স্বামীর বাড়ি পাটকেলঘাটায়- যেখানে তিনি বসবাস করেন। তার নামে বরাদ্দকৃত ঘরটি তালা ইউপি অফিস (হাসপাতাল)-জাতপুর সড়কের পোল্ট্রি ফার্মের পেছনে সোলিং রাস্তার পার্শ্বে নির্মাণ করা হয়েছে- যা বর্তমানে কোচিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে কোনো লোকজন বসবাস করে না। সাজেদা বেগম ওই ঘর পাওয়ার যোগ্য নয়। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার মুন্সিগঞ্জের পূর্ব কালীনগর গ্রামের সন্দিপ কুমার মৃধার মাছের ঘের ও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। তারপরও তার নামে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের যতীন্দ্রনগর গ্রামের মো. লুৎফর রহমানের ৫ বিঘা জমি ও তিনটি ঘর রয়েছে। তারপরও তার নামে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার ডুমুরিয়া, গাবুরা গ্রামের আবদুল মান্নান, হবিয়ার রহমান ও আবদুল মজিদের মৎস্য ঘের ও ৬ বিঘা করে জমি রয়েছে। তারপরও তাদের নামে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আশাশুনি উপজেলার কুল্যা ইউনিয়নের ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৩ জনের মধ্যে ১০ জনই ঘর বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য নয় বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরো প্রতিবেদনে মোট ৪৫ জন ঘর বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হলেও তাদের নামে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে যারা ঘর বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য নয় তাদেরকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঘর বরাদ্দপ্রাপ্তদের অধিকাংশই দরিদ্র, দুস্থ, আর্থিক অসচ্ছল, ক্ষতিগ্রস্ত এবং গৃহহীন নন। জেলা পরিষদের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় ঠিকাদার ও সরকার সমর্থক প্রভাবশালীদের কারণে প্রকৃত অসহায় ব্যক্তিরা ঘর বরাদ্দ পাননি। সাতক্ষীরার চাম্পাফুল ইউনিয়নের ১৬টি ঘর বরাদ্দে অনিয়ম হয়েছে দাবি করে তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন একই ইউনিয়নের দীপঙ্কর মণ্ডল, হরিদাস সরকার ও মো. নুরুজ্জামান। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে যে ঘরগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের ওই নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তা হস্তান্তর করায় আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হয়েছে। রিটকারীদের আইনজীবী সত্য রঞ্জন মণ্ডল জানান, ‘জেলা পরিষদ ওই তিন রিটকারীকে এখন বাড়ি বরাদ্দ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এ কারণে ৬ মে তারা রিট আবেদনটি প্রত্যাহারের জন্য হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছেন। এ অবস্থায় আমরা আরও ৯ জনকে বাদী করার আবেদন করলে হাইকোর্ট দুটি আবেদনই মঞ্জুর করেছেন।’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘এ অবস্থায় আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন ঘর নির্মাণকারী ঠিকাদার ও জেলা পরিষদের সুবিধাভোগী এবং স্থানীয় প্রবাবশালী মহল। ৮ মে আমি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার কুমারখালীর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে তারা আমার ওপর হামলার প্রস্তুতি নেয়। সেদিন ৬০ থেকে ৭০ জন লোক আমার বাড়িতে গিয়ে না পেয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে এসেছে ও গালিগালাজ করে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে গেছে। এজন্য আমি কালীগঞ্জ থানায় ইমেইলে একটি জিডি করার আবেদন জানিয়েছি।’ জিডিটি নথিভুক্ত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কালীগঞ্জ থানার ওসি যুগান্তরকে বলেন, জেলা প্রশাসক একজন সরকারি কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে তদন্ত ছাড়া জিডি গ্রহণ করা যাবে না। সরাসরি তদন্ত হবে। তারপর জিডি নথিভুক্ত হবে। তাছাড়া সে ইমেইলে পাঠিয়েছে, সেটাও সত্য কিনা দেখতে হবে।  

No comments:

Post a Comment