রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র নীলক্ষেতে সিটি করপোরেশনের মার্কেট নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। সিটি করপোরেশনের শত কোটি টাকার সম্পত্তিতে পুরনো আধাপাকা মার্কেট ভেঙে অবৈধভাবে নতুন বহুতল মার্কেট নির্মাণ করছে একটি মহল। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে নকশা অনুমোদন না করিয়েই একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বানানো হচ্ছে এ বাণিজ্যিক ভবন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির কাছে ভবন নির্মাণের কোনো বৈধ কাগজপত্রও নেই। নিজেদের স
ম্পত্তিতে কারা এ ভবন নির্মাণ করছে সে বিষয়ে স্পষ্ট জবাব দিতে পারছেন না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে করপোরেশন থেকে এ সম্পত্তির নথি উধাও হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ডিএসসিসি, রাজউক, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রান্ত থেকে নিউ মার্কেট মোড় পর্যন্ত রাস্তার দক্ষিণ পাশে তুলা মার্কেট নামে পরিচিত বিশাল আকৃতির এ মার্কেট কয়েক যুগ ধরে সিটি করপোরেশনের দখলে। সেখানে প্রায় এক বিঘা জমির ওপর আধাপাকা মার্কেট ভেঙে অবৈধভাবে রাতারাতি নতুন বহুতল মার্কেট গড়ে উঠতে দেখে অবাক স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ডিএসসিসি এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এরই মধ্যে তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়ে গেছে। রাজধানীতে যেকোনো ভবন বানানোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্টহারে জায়গা ছাড়ার নিয়ম থাকলেও এ মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে ফুটপাতের জায়গাও দখলে নিয়ে। ব্যবসায়ীরা জানান, এরই মধ্যে ১১১ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা করে আদায় করা হয়েছে দোকানের পজেশন বিক্রির কথা বলে। বিষয়টি ডিএসসিসির প্রশাসক থেকে শুরু করে সবাই অবগত। কিন্তু তাদের নীরবতায় বিনা বাধায় গোপনে দ্রুত কাজ শেষ করছে লাবলু অ্যান্ড কম্পানি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এদিকে রহস্যজনক অবস্থায় মার্কেট নির্মাণ ও দোকান বিক্রির সঙ্গে ডিএসসিসির প্রশাসকের একান্ত সচিব (পিএস) ও সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানসহ উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সরকারদলীয় একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জামাল হোসেনও এর সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. জামাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মার্কেটের দুটি অংশের মধ্যে আমরা মূলত পেছনের অংশে নির্মাণকাজ করেছি বৈধ কাগজপত্রের ভিত্তিতে। সামনের অংশে নির্মাণকাজ করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অংশ বৈধ, না অবৈধ তা বলতে পারব না।’ জানা যায়, সিটি করপোরেশনের মার্কেটগুলো আগে দেখভাল করত সংস্থার সম্পত্তি বিভাগ। কয়েকটি মার্কেট নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির পর তাদের সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় রাজস্ব বিভাগের ওপর। নিয়ম অনুসারে কেউ অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ পেলেও সেখানে স্থায়ী ভবন বা মার্কেট নির্মাণ করবে ডিএসসিসি। সেই সূত্রে নীলক্ষেতের এ মার্কেটের বিষয়ে জানতে নগর ভবনে গেলে প্রথমে কথা হয় সংস্থাটির উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সর্দারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুসারে আমরা মার্কেট দেখভাল করলেও নির্মাণের কাজ করছে প্রকৌশল দপ্তর। এ ব্যাপারে তারা বিস্তারিত বলতে পারবে।’ এরপর ডিএসসিসির অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. বাকের হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্পত্তি বিভাগ এ কাজ করছে। পরে সম্পত্তি বিভাগে গেলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। সেখানে নেই শত কোটি টাকার এ সম্পত্তির নথি। কর্মকর্তারা জানেন না কারা এ মার্কেট বানাচ্ছে। জানতে চাইলে প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তারা কিসের ভিত্তিতে আমাদের জায়গায় ভবন নির্মাণ করছে জানা নেই। আবার আমরা তেমন কোনো কাজও করতে পারছি না এ-সংক্রান্ত নথি পাওয়া যাচ্ছে না বলে। নথি খোঁজার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার দায়িত্বে আছেন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।’ এ ব্যাপারে কমিটির প্রধান ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কবির মাহমুদ বলেন, ‘দুই-আড়াই মাস এ নথি খোঁজাখুঁজি করেও তা পাওয়া যায়নি। ফলে এখন নথির ব্যাপারে আর তেমন কিছু করারও নেই।’ সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রশাসক মো. ইব্রাহিম হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি খুব বিব্রতবোধ করছি। সবই তো বোঝেন। আমি মন্তব্য করতে চাই না।’ রানা প্লাজা ধসের পর থেকে বিল্ডিং কোড মানতে সবাইকে বাধ্য করেছে সরকার। অথচ নীলক্ষেতে এ ভবন উঠছে রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই। এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) শেখ আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজউকের এখতিয়ারের ভেতরে যেসব ভবন হবে সেগুলোর অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সরকারি সংস্থা হয়ে সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।’ রাজউকের অথরাইজড অফিসার আমিনুর রহমান সুমন বলেন, ‘যেখানে নীলক্ষেতের জায়গাটি সিটি করপোরেশনের সেখানে কেউ অনুমোদন না নিয়ে ভবন করলে নিয়ম অনুসারে করপোরেশন আমাদের চিঠি দিলে ব্যবস্থা নিতে পারি।’ তবে তিনি জানান, নিয়ম না থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন তাদের প্রধান প্রকৌশলীকে দিয়ে নকশা অনুমোদন করিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার নীলক্ষেতে ওই মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, লাবলু অ্যান্ড কম্পানির পক্ষে ভবন নির্মাণকাজে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে রয়েছেন দুলাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। এ মার্কেট কারা নির্মাণ করছে জানতে চাইলে দুলাল বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাদের কম্পানি শুধু ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। একই কথা জানান, প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহাদাৎ হোসেন লাবলুও। তিনি বলেন, ‘নিয়মকানুন সবই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে রয়েছে। আইন মেনেই আমরা কাজ করছি। কিন্তু এখন শুনছি আমাদের অস্থায়ী বরাদ্দ বাতিল করা হবে।’ ডিএসসিসির কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো আমার কাছে নেই। সিটি করপোরেশনেই থাকার কথা।’ ডিএসসিসির আইন কর্মকর্তা করিম খান বলেন, ‘এ জায়গার কিছু অংশ নিয়ে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সঙ্গে আমাদের একটি মোকদ্দমা ছিল। পরে আদালতের রায় আমাদের অনুকূলে এসেছে। বর্তমানে এ মার্কেট নিয়ে কোনো আইনি জটিলতাও নেই।’ ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, প্রশাসক মো. ইব্রাহিম হোসেন খানের পিএস হিসেবে দায়িত্বরত সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট অন্য দপ্তরের লোকজনও মার্কেট নির্মাণের সিন্ডিকেটের সঙ্গে রয়েছেন। বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান প্রশাসকের আত্মীয় হওয়ায় তাঁর প্রভাব রয়েছে নগর ভবনে। ঠিকাদার শাহাদাৎ হোসেন লাবলুকে দিনের পর দিন মনিরুজ্জামানের রুমে বসে থাকতে দেখা যায়। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারাও জড়িত বলে জানান একাধিক কর্মকর্তা। জানতে চাইলে ডিএসসিসি প্রশাসকের পিএস মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রথমে নির্মাণকারীদের পক্ষে নানা যুক্তি দেন। পরে করপোরেশন বা রাজউকের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে সরকারি মার্কেট করা যায় কি না জানতে চাইলে সুর পাল্টে তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নির্মাণ হচ্ছে এ মার্কেট। এ ব্যাপারে কথা বলতে হলে আমাকে কয়েক দিন সময় দিতে হবে।’ জানা যায়, নীলক্ষেতে এ মার্কেটটি বহু বছর ধরে সিটি করপোরেশেনের হাতেই ছিল। ২০১২ সালে সম্পত্তি কর্মকর্তা দিদারুল আলম একটি সমিতির নামে অস্থায়ী বরাদ্দ দেন। এ নিয়ে বিতর্ক হলে অনিয়মের ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে করপোরেশন। এরপর দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পেয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। বর্তমানে এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। বিসিএস (প্রশাসন) ২৪তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা বর্তমানে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দিদারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে আমরা একটি সমিতির আবেদনের বিপরীতে বরাদ্দ প্রদান করি। এরপর এ নিয়ে কতিপয় দুষ্কৃতকারী বিভিন্ন অভিযোগ এনে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।’ ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের জায়গা অস্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেখানে বহুতল মার্কেট করার প্রয়োজন হলেও তা বাস্তবায়ন করবে করপোরেশন। কিন্তু কোন ব্যক্তি কিভাবে এ ভবন তৈরি করছে? রাজউকের কোনো অনুমোদন না থাকার পরও নাকের ডগায় এ অবৈধ ভবন দাঁড়িয়ে গেছে। এতেই বোঝা যায় বড় একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ম্যানেজড হয়ে গেছেন। করপোরেশনের দোকানপাঠের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দুর্নীতির কারণে একের পর এক মার্কেট হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মার্কেট নিয়ে অনিয়মের জন্য করপোরেশনের প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী দুদকের মামলায় আসামি হয়েছেন। কিন্তু তবুও থেমে নেই দুর্নীতি।’ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, কোনো রকম বৈধতা না থাকার পরও ১১১টি দোকানের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিটি দোকান বাবদ ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এমনকি বেশির ভাগ দোকানই প্রথম হাত থেকে বদল হয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হাতে গিয়ে পড়েছে। পরিচয় গোপন রেখে জানতে চাইলে মার্কেটের ব্যবসায়ী সাব্বির এর সত্যতা নিশ্চিত করেন।
No comments:
Post a Comment