সরকারবিরোধী আন্দোলনে এবার কৌশল ও ধরন পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে ‘কারফিউ’য়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি না করে জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামানোর মতো কর্মসূচি নিয়ে এবার মাঠে নামবে দলটি। এ লক্ষ্যে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঢাকায় দেওয়া হবে পদযাত্রা কর্মসূচি। এ ছাড়া সংসদ ভবন ঘেরাও ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির কথাও সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে সরকারের প্রধান প্রতিপক্
ষ এই দলটির। তবে এসব কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন শুরুর আগে আগামী মাসে অর্থাৎ নভেম্বরে দলটির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একগুচ্ছ দাবিনামা তুলে ধরা হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে পরিবর্তন আনার দাবিও উত্থাপন করা হবে বিএনপির পক্ষ থেকে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরে ঢাকায় একটি জনসভা অথবা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এসব দাবি তুলে ধরে সরকারকে তা মানার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই সময়ের মধ্যে দাবিগুলো মানতে কিংবা কোনো ধরনের সংলাপ বা আলোচনায় সরকার রাজি না হলে প্রথমে অপেক্ষাকৃত হালকা এবং পর্যায়ক্রমে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। আর এ ভাবেই আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জানুয়ারি পর্যন্ত। জানুয়ারির মধ্যে অলোচনার ব্যাপারে সরকার নমনীয় না হলে আরো কঠোর কর্মসূচির দিকে যাওয়া হবে। জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, সময়ের প্রয়োজনে অবশ্যই এবার আন্দোলনের ধরন পরিবর্তন হবে। তা ছাড়া রাজনৈতিক আন্দোলনের গতি সব সময় এক হয়ও না। তিনি বলেন, একান্ত প্রয়োজন না হলে এবার হরতাল দেওয়া হবে না। তবে জনগণ রাজপথে নামতে উদ্বুদ্ধ হয় এমন কর্মসূচি নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের মনোভাব বুঝে আন্দোলন-কৌশল ঠিক করা হবে। সরকার আগের মতো মারমুখী হলে এক রকম, আবার গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে আরেক রকম। তবে এটুকু বলব, ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন একটি দেশে বারবার হয় না। এই অলিক পরিকল্পনা করে সরকারের লাভ নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আন্দোলন কৌশল এখনই খোলাসা করা যাবে না। তবে এটা ঠিক, সরকারের বিরুদ্ধে একটা কিছু করতে হবে। আর বসে থাকার সময় নেই। তাঁর মতে, সরকার নিজেই ভয়ে আছে; তা না হলে আন্দোলনের হুমকিতেই যুবদলের সভাপতিসহ ৬৪ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো কেন? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নেতা-কর্মীদের জেলখানায় নিলেই আন্দোলন থেমে যাবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শেখ মুজিবকে জেলে নেওয়ার পর একসময় আওয়ামী লীগ অফিসে বাতি দেওয়ারও লোক ছিল না। কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি। আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। তিনি বলেন, কোন ঘটনায় আন্দোলন কিভাবে স্পার্ক করবে বলা যায় না। সরকার আগের মতো ‘ঢাকা সিজ’ করলে কী করবেন জানতে চাইলে গয়েশ্বর রায় বলেন, সারা দেশ সফল হলে এবার ঢাকাও সফল হবে। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ‘গণতন্ত্রের জন্য অভিযাত্রা’ কর্মসূচি দেওয়া বিএনপির জন্য বড় ধরনের ভুল ছিল বলে দলটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা মনে করেন। এ ছাড়া ২০১৩ সালের মার্চে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরকালে তাঁর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সত্ত্বেও জামায়াতের ডাকা হরতালের অজুহাতে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ করতে না যাওয়াও বড় ধরনের আরেকটি ভুল বলে নেতাদেরই মূল্যায়ন। তাঁদের মতে, এসব বিষয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। কর্মসূচির বিষয়টি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে তা সফল হতো বলেও মত তাঁদের। ফলে কিভাবে ও কাদের পরামর্শে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তা নিয়ে খালেদা জিয়া ছাড়া বাদবাকি অধিকাংশ নেতার এখনো কৌতূহল রয়ে গেছে। এ নিয়ে দলের মধ্যে এক ধরনের ‘ব্লেমগেম’ বা দোষারোপের রাজনীতি চলছে। কারণ বিএনপি নেতারা মনে করেন, ওই কর্মসূচির কারণেই ঢাকায় কারফিউ পরিস্থিতি তৈরি হয়, আর এ জন্যই নেতা-কর্মীরা রাজপথে নামার সাহস পায়নি। তার চেয়ে অবরোধ কর্মসূচি বহাল থাকলে ফল ভালো হতো বলে অনেকে মনে করেন। তাই এবারে জনগণকে সম্পৃক্ত করার মতো কর্মসূচি নিয়ে ভাবা হচ্ছে। পারতপক্ষে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করার মতো কর্মসূচি তারা দেবে না। এদিকে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে প্রতিবেশী ভারতের বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে অন্তত ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। দলের বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ জন্য কাজ করছেন বলে দায়িত্বশীল একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, আন্দোলনে দেশ ভেসে গেলেও লাভ নেই যদি না বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত অন্তত নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে। দলটির প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, যত আন্দোলনই হোক; ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র বলে পরিচিত প্রশাসন নড়াচড়া না করলে সরকারের পতন হয় না। তাঁর মতে, এবারে সারা দেশে দুর্বার আন্দোলন হলেও ঢাকার আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতি পায়নি শুধু সরকারের প্রতি তৎকালীন ভারত সরকারের সমর্থনের কারণে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে আগের অবস্থানে অর্থাৎ ‘অংশীদারিত্বমূলক’ নির্বাচনের পক্ষে রাখার জন্যও তৎপরতা চালাচ্ছে বিএনপি। এ জন্য বিএনপির পাশাপাশি সরকারবিরোধী সুধী সমাজের একাধিক প্রতিনিধিও কাজ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক নেতা জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ওই কূটনীতিকরা জনগণকে সংগঠিত করার বিষয়ে জোর দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়ে চাপ দিলেও তা কাজে লাগবে না। ফলে বিএনপি মনে করে, আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারলে নির্বাচনের ব্যাপারে একপর্যায়ে বাইরের চাপও আবার আসবে। এদিকে, ২০ দলীয় জোট ভেঙে জামায়াতকে এবং বিএনপি ভেঙে একাংশকে নিয়ে সরকার হঠাৎ আগাম একটি নির্বাচন দিয়ে দিতে পারে এমন আশঙ্কাও বিএনপির মধ্যে রয়েছে। তাই সরকারের সম্ভাব্য এ উদ্যোগ অকার্যকর করার জন্যও সতর্ক রয়েছে বিএনপি।
No comments:
Post a Comment