দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনের পাঁচটি ধারা-উপধারার প্রয়োগ নিয়ে চলছে যথেচ্ছাচার। কোনো কোনো ধারার জোরে পার পেয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। আইনগত দুর্বলতার কারণে স্পর্শ করা যাচ্ছে না বড় বড় দুর্নীতিবাজদের। আবার কোনো ধারা ব্যবহৃত হচ্ছে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে। এ ধরনের ধারার ঐচ্ছিক প্রয়োগে বেড়েছে হয়রানি। প্রয়োগহীনতাও আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার প্রয়োজনীয়তাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। দুদক আইনে মোট ৩৮টি ধারা আছে। এর মধ্যে
১৯(১), ১৯ (১) (ঘ), ১৯(৩), ২২, ৩৩ (১) ধারা ও উপধারাকে কেন্দ্র করে এসব প্রশ্ন উঠছে। এসব ধারা-উপধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুদক কর্মকর্তাদের এখতিয়ারের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। অভিযোগ উঠেছে, দুদকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই আইনের ফাঁকফোকর বের করে দুর্নীতিবাজদের পার পেয়ে যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিচ্ছেন। দুদক আইনের প্রয়োগ, অপপ্রয়োগ, প্রয়োগহীনতা, হয়রানি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দুদক আইনে হয়রানিমূলক কোনো ধারা-উপধারা নেই। প্রয়োগ হচ্ছে না এমন কোনো ধারা বা উপধারা আইনে নেই। কম প্রয়োগ হচ্ছে, একথা বলা যায়। জনবল স্বল্পতার কারণেই অনেক সময় কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীই কঠোর জবাবদিহিতার মধ্যে আছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আইনগত সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিতের চেষ্টা করছি। তফসিল থেকে কিছু অপরাধ বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আইনি জটিলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।’ দুদক আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ সম্পর্কে ড. শাহদীন মালিক বলেন, আপাত দৃষ্টিতে আইনের এ ক’টি ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগ প্রতীয়মান হয়। তবে দুদকের যথেচ্ছাচারী হওয়ার অবকাশ নেই। কোনো ধারা হয়রানিমূলক থেকে থাকলেও সেগুলো স্ক্রুটনি করে বাদ দেয়া উচিত। তিনি বলেন, আইনের ইচ্ছামতো প্রয়োগের মানে হচ্ছে দুর্নীতি দমনের পরিবর্তে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া। দুদকের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সংসদীয় কমিটির তদন্ত করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। আইনের ২২ ধারায় কমিশনকে একটি এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। এই এখতিয়ার বলে কমিশন প্রয়োজন মনে করলে অনুসন্ধান বা তদন্ত চলাকালে যেকোনো পর্যায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য নিতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য শোনার পর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিতে পারে। আবার অব্যাহতি নাও দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির অভিযোগ নথিভুক্ত করা অথবা তার নামে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেও কারও কিছু বলার বা করার সুযোগ নেই। এই ধারায় দেয়া এখতিয়ার বলে কমিশন এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি। অথচ এই ২২ ধারায় শুনানিগ্রহণ ঐচ্ছিক হলেও ধারাটিতে শুনানির পর কমিশনের করণীয় নির্ধারণ নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়া যাবে কিনা সে সম্পর্কেও কিছু উল্লেখ করা নেই। তবু কোনো প্রকার ব্যাখ্যা না দিয়েই কমিশন প্রভাবশালী অভিযুক্তদের অব্যাহতি দিচ্ছে। সম্প্রতি এ ধারার আওতায় শুনানিতে অংশ নেয়ার পর বিপিসির দুর্নীতির একটি মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় চার সচিবসহ পাঁচ আসামিকে। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারে ডিসিসির দোকান বরাদ্দসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে মামলা রুজুর সুপারিশ থাকলেও বাদ দেয়া হয়েছে সরকারদলীয় প্রভাবশালী এমপিকে। এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের এখতিয়ার থাকতেই পারে। কিভাবে এই ‘এখতিয়ার’র প্রয়োগ হচ্ছে সেটি হচ্ছে বিষয়। যদি এমন হয়, এই এখতিয়ারের আওতায় শুধু প্রভাবশালীরা দায়মুক্তি পাচ্ছেন, দুর্বল এবং সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভিকটিমাইজ হচ্ছেন তাহলে সেটি অপপ্রয়োগ। জানা গেছে, অভিযোগ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য নেয়ার জন্য দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কমিশন আইন ১৯ ও ২০ ধারা এবং কমিশনের বিধিমালার ২০ বিধিসহ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬০ ধারায় নোটিশ করেন, যা ‘তলবি নোটিশ’ নামে পরিচিত। এ ধরনের নোটিশ পেয়ে দুদকে হাজির হচ্ছেন মন্ত্রী, এমপি, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এসব ধারার ক্ষমতা বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ নেই এমন লোকজনকে ডেকে পাঠান। এতে একদিকে লোক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বক্তব্য নেয়ার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হয়। অন্যদিকে সরাসরি অভিযোগ নেই এমন লোককে দুদকে ডেকে সম্মান হানি করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। দুদক আইনের ১৯ (১) (ক) উপধারা অনুযায়ী কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনুসন্ধান কর্মকর্তা সাক্ষীর সমন জারি ও উপস্থিতি নিশ্চিত করে থাকেন। একই সঙ্গে শপথের মাধ্যমে সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদের বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও দেখভাল করেন। কিন্তু আইনটি সংশোধন করে ‘শপথ গ্রহণ’ অংশটুকু বাদ দেয়া হয়। এতে দুদকে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দেয়ার বিধানটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সাবেক মন্ত্রী বা আমলা অথবা রাজনৈতিক দলের নেতা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা যথাসময়ে দুদকে হাজির না হওয়ার বিষয় লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়া শুরু করেন। লিখিত বক্তব্যটি গ্রহণ করা বা না করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে দুদক কর্মকর্তাকে। আমলা, সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের বক্তব্য গৃহীত হচ্ছে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলের কেউ এ ধরনের বক্তব্য দিলে তা গ্রহণ না করে ওই নেতার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। দুদক আইন সংশোধনের ফলে এ সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনুসন্ধানকালে সাক্ষীকে সমন জারি ও সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ‘ঐচ্ছিক’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মকর্তা ইচ্ছা করলে কাউকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ডাকতে পারেন, আবার নাও পারেন। এক্ষেত্রে দুদক কর্মকর্তার ‘ইচ্ছা’ এবং ‘অনিচ্ছা’র বিষয়টি জনহয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, অনুসন্ধান বা তদন্তে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ নির্দিষ্ট বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত না পাওয়া। অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে দুদক আইনের ১৯ (১) (ঘ) ধারায় নথিপত্র তলব করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এজন্য সময় বেঁধে দেয়া হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুদক তথ্য-উপাত্ত পায় না। গড়িমসি করে প্রতিষ্ঠান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুদকের ওই চাহিদাপত্রকে গুরুত্বই দেয় না। বিশেষ করে ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, মন্ত্রণালয়, সরকারি দফতর, ভূমি অফিস, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, রাজউক, সিটি কর্পোরেশনে দুদকের অধিকাংশ চাহিদাপত্রই উপেক্ষিত হয়। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত। অথচ দুদক আইনের ১৯ (৩) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান ও তদন্তে বাধা দেয়া বা অসহযোগিতা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ জন্য তিন বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। অধিকাংশ অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনায় দুদক বাধাগ্রস্ত হলেও এ আইনটির প্রয়োগ করে না। তদন্তে সহযোগিতা না করার অভিযোগে গত এক দশকে বরিশালের কোতোয়ালি থানায় দায়েরকৃত একটি মামলার {০৭(১২)১২} সাজা হয়েছে বলে জানা যায়। ২৩ জুলাই বরিশাল জজ আদালত আলমতাজ বেগম নামে একজনকে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন। জরিমানাকৃত অর্থ পরিশোধসাপেক্ষে সাজা মওকুফের আদেশ দেয়া হয়। গাজী ওয়াজেদ বাদী হয়ে মামলাটি রুজু করেন। এরপরও দুদক কর্মকর্তারা এই ধারাটি প্রয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী নন। কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্ট দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুদক আইনের ১৯ (১) (ঘ) ধারায় অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে চিঠি দেন। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংকই ১৮৯১ সালের ‘ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্ট’র দোহাই দিয়ে তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছে না। যদিও ২০১৩ সালের সংশোধনীতে দুদক আইনকে অন্য আইনের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু আইনটিতে ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কিনা বিতর্ক রয়েছে- যার সুফল পাচ্ছেন সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজরা। অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মতে, আইনগত লড়াই দুদকের মূল কাজ। অথচ এ লড়াইয়ে দুদককে নির্ভর করতে হচ্ছে ফি-নির্ভর আইনজীবীর ওপর। গত এক দশকে কয়েক কোটি টাকা শুধু আইনজীবী ফি পরিশোধ করা হলেও বিপরীতে কতগুলো মামলায় দুদক চূড়ান্তভাবে জয় লাভ করেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। উচ্চ আদালতে অধিকাংশ মামলায় হারলেও ফি-নির্ভর আইনজীবীদের জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা নেই দুদকে। অথচ দুদক আইনের ৩৩ (১) ধারায় নিজস্ব একটি প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনের কথা বলা হয়েছে। দুদক প্রতিষ্ঠার পর কয়েকটি কমিশন গত হলেও নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। গত বছরের ২০ নভেম্বর দুদক আইন সংশোধন হয়। এতে দুদকের ৩৮টি ধারার সঙ্গে যুক্ত হয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৮, ৪২০, ৪৬৫, ৪৬৬ ও ৪৬৭সহ বেশ কিছু ধারা। এতে দুদকের কার্যপরিধি বেড়ে যায়, সৃষ্টি হয় নতুন জটিলতা। বিশেষ করে ৪০৮ (অধীনস্থ কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলা) ধারা যুক্ত হওয়ার পর এ ধারায় সংগঠিত অপরাধের মামলা তদন্তের দায়িত্ব চলে আসে দুদকের হাতে। ফলে দেশের সব থানা এবং আদালতে দায়েরকৃত শত শত নালিশি (সিআর) মামলা চলে আসে দুদকে। বিদ্যমান জনবল দিয়ে এসব মামলার অনুসন্ধান-তদন্ত সম্ভব নয় বিধায় দুদক তফসিল থেকে কিছু আইন বাদ দেয়ার সুপারিশ পাঠায় দুদক। এখনও ওই সুপারিশ সংসদে ওঠেনি। ফলে দুদকে অভিযোগ ও মামলা জট বেড়েই চলছে। দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধগুলো আমলে নিতে না পারায় আদালতেও উঁচু হচ্ছে মামলার স্তূপ।
No comments:
Post a Comment