বিদেশি ক্রেতারা অর্থ দিচ্ছেন না। পোশাক কারখানা মালিকদের সমিতি বিজিএমইএরও আগ্রহ নেই। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের অর্থ পড়ে আছে। হাইকোর্ট থেকেও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলে রানা প্লাজা ধসে আহত-নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে একধরনের অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। তাই আপাতত ক্ষতিপূরণের অর্থ কিস্তি আকারে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে আইএলও গঠিত সমন্বয় কমিটি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও
) নেতৃত্বাধীন রানা প্লাজা ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি বা রানা প্লাজা অ্যারেঞ্জমেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির তহবিলে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার বা ১৪১ কোটি টাকা জমা পড়েছে। যদিও ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজন ৩২০ কোটি টাকা বা চার কোটি ডলার। আবার প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ের কোনো পরিকল্পনার কথা জানানো হচ্ছে না। সমন্বয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও আহত শ্রমিকদের একটি অংশ ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তির অর্থ ঈদুল ফিতরের আগে পেতে পারেন। ক্ষতিপূরণের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে তাঁদের নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে অর্থ চলে যাবে। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে গত মার্চে দাবিনামা বা ক্লেইম ফরম পূরণ শুরু করে রানা প্লাজা ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি। সাভার সেনানিবাসে ‘রানা প্লাজা ক্লেইমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিস’ নামে একটি কার্যালয় স্থাপন করে কমিটি। হতাহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনেরা এখানে গিয়ে ফরম পূরণ করেন। একই সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যেক উত্তরাধিকারের জন্য আলাদা ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৭৬৩ জন হতাহতের পরিবারের দাবিনামা পূরণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬০ জন নিহত শ্রমিকের পরিবার। যদিও মোট নিহতের সংখ্যা এক হাজার ১৩৬। বর্তমানে দাবিনামাগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। ঈদের আগে ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তি দেওয়ার বিষয়ে সমন্বয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে ৭০০ জনের ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তির টাকা ব্যাংক হিসেবে চলে যাবে। আর বাকিদের ফরম যাচাই-বাছাই শেষ হলে একইভাবে অর্থ দেওয়া হবে। তবে কমিটির আরেক সদস্য, ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের মহাসচিব রায় রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তি দেওয়ার বিষয়ে আজ বুধবার কমিটির সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে আমরা ঈদের আগেই আংশিক হলেও ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ দিতে চাই। সে জন্য জোর চেষ্টা চলছে।’ ভবন ধসের পর গত বছর ক্ষতিগ্রস্ত তিন হাজার ৬৩৯ জনকে নয় মাসের বেতন বাবদ ৪৫ হাজার টাকা করে বিকাশের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এই অর্থের জোগান দেয় আয়ারল্যান্ডভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রাইমার্ক। আর এক বছর পূর্তির আগে ‘রানা প্লাজা ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ড’ নামের আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজার ৯২৯ জনকে ৫০ হাজার টাকা করে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল গত বছরের ২৪ এপ্রিল। এরপর শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা ভাবমূর্তি পড়ে যায় সংকটে। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কাজ শুরু করেন মালিকেরা। পুরো ক্ষতিপূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা: গত জুনের শেষ দিকে ব্রিটিশ বিভিন্ন পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে চিঠি পাঠিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান-এর সংবাদ অনুযায়ী, দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী অ্যালান ডানকান ম্যাটালানসহ বেশ কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে তহবিলে অর্থ দিতে বলেছেন। এরপর এখন পর্যন্ত কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই তহবিলে অর্থ দেওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। আর ২৮ জানুয়ারি ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের পর থেকে গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত জমা পড়েছিল এক কোটি ৭০ লাখ ডলার। তারপর থেকে গত ৪ জুলাই পর্যন্ত তহবিলে নতুন করে জমা পড়ে মাত্র সাত লাখ ডলার। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পুরো অর্থ পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন সূত্রে জানা যায়, রানা প্লাজার পাঁচ কারখানায় পোশাক তৈরি করাত এমন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯। এর মধ্যে ১৬ প্রতিষ্ঠান তহবিলে অর্থ দেয়নি, কোনো প্রতিশ্রুতিও দেয়নি। আর যেসব ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দিয়েছে, তাদের বেশির ভাগেরই অল্প পরিমাণে। একমাত্র ব্যতিক্রম প্রাইমার্ক, ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিষ্ঠানটি দিচ্ছে ৯০ লাখ ডলার। এই অর্থ দিয়ে রানা প্লাজার দ্বিতীয় তলায় থাকা নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেডের ৫৮০ জন শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আইএলওর কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা এখনো আশা ছাড়ছি না। ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’ শেষ পর্যন্ত অর্থ না পাওয়া গেলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে কমিটির পক্ষ থেকে সরকার ও বিজিএমইএর কাছে তহবিলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থ চাওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে পোশাক কারখানা মালিকদের সমিতি বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই, রানা প্লাজা ধসে নিহত ও আহত শ্রমিকেরা ক্ষতিপূরণ পাক। সে জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া না গেলে এবং তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পেলে বিজিএমইএ উদ্যোগ নেবে। সে ক্ষেত্রে হয়তো সাধারণ সভা (ইজিএম) করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ তহবিলের অর্থের খোঁজ নেই: রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের অনুদান দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা পড়ে। তহবিল থেকে হতাহতদের জন্য খরচ করা হয়েছে মাত্র ২২ কোটি টাকা। গত ২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক সংবাদ সম্মেলন করে এই খরচের হিসাব দেওয়া হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই এই তহবিল থেকে অনুদানই পাননি। এমনকি বাকি টাকা কবে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ হবে, নাকি আদৌ হবে না সে বিষয়ে সরকার থেকে কিছুই বলা হচ্ছে না। রানা প্লাজা ধসে আহতদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের অর্থের হিসাব চেয়ে গত সেপ্টেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত আটবার চিঠি দিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক। চিঠিতে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এই ত্রাণ তহবিলের টাকার কতটা কার জন্য খরচ হয়েছে সেটি সংসদ বা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের মাধ্যমে জনগণকে জানানোর অনুরোধ করেন। তবে একবারও চিঠির জবাব দেয়নি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নবমবারের মতো চিঠি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ একটি বিশেষ কাজে বিশ্বাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে অর্থ দিয়েছেন। তাই এই টাকা জনগণের জন্য যে খরচ হয়েছে তা নিশ্চিত করতে জবাবদিহি প্রয়োজন। জনগণ সেটি জানতে চায়। কারণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে আমরা জানতে পেরেছি, ভুক্তভোগী অনেকেই অনুদান পাননি। আবার পেলেও কেউ কেউ ১০-২০ হাজার টাকা পেয়েছেন।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কেন খরচের পূর্ণাঙ্গ হিসাব প্রকাশ করছে না—জানতে চাইলে শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমার মনে হয়, জনগণের কাছে জবাবদিহি দেওয়ার বিষয়টি এখন গণতন্ত্রে উপেক্ষিত। সরকার মনে করছে, আমি ক্ষমতায় আছি, যেটা ভালো মনে করব তাই করব। এটা মনে হয় উপলদ্ধি করছেন না, জবাবদিহি কতটা প্রয়োজন।’ সিদ্ধান্ত দেননি হাইকোর্ট: ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের বেঞ্চের স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি উদ্যোগ নেয়। গত বছরের আগস্টে গঠন করা হয় ৩১ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি। কমিটি দুটি উপকমিটি করে আহত-নিহত ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিপূরণের একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক নির্ধারণ করে চলতি বছর হাইকোর্টে সুপারিশ আকারে জমা দেয়। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। অবশ্য ওই সুপারিশেও বাগড়া দিয়েছিল বিজিএমইএ। ওই কমিটির সদস্য বিজিএমইএর এক নেতা চূড়ান্ত সুপারিশে স্বাক্ষর করলেও তাতে লিখে দেন, ক্ষতিপূরণ শ্রম আইন অনুযায়ীই হতে হবে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রত্যেক নিহত, নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী শ্রমিকেরা পাবেন দেড় লাখ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা। তবে এ ক্ষেত্রে এখনো সিদ্ধান্ত না দিলেও হাইকোর্টের নির্দেশে ভবনমালিক সোহেল রানার ব্যক্তিগত ছয় বিঘা জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ উপকমিটির প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার রানা প্লাজা নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা না দেওয়া ও দোষী ব্যক্তিরা এখনো চিহ্নিত না হওয়ার জন্যই হাইকোর্ট থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়াটা বিলম্ব হচ্ছে। কারণ এটি না হলে কে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেবে সেটি চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে এম এম আকাশ বলেন, হাইকোর্ট থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না এলে বিজিএমইএর লাভ হয়। কারণ সমন্বয় কমিটি যেটি করছে সেটি শুধুই রানা প্লাজার জন্য। ফলে ভবিষ্যতের জন্য প্রযোজ্য হবে না। আর হাইকোর্ট থেকে সিদ্ধান্ত এলে সেটি আইন আকারে না হলেও অনুকরণীয় হয়েই থাকত। তাতে শ্রমিকদের জীবনের নিশ্চয়তা বাড়ত। মালিকেরাও সর্তক ও সচেতন থাকতেন।
No comments:
Post a Comment