বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক হিসেবে যে তৈরী পোশাক সম্ভাবনাময় দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ, সেই শিল্পের কারণেই বিশ্ববাজারে এখন চরম ভাবমর্যাদা সঙ্কটে ভুগছে দেশ। প্রতিনিয়ত শ্রমিক অসন্তোষ, কারখানা ভাঙচুর, পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে আমিনুল ইসলামসহ বহু শ্রমিকের মৃত্যু। হা-মীম, গরিব অ্যান্ড গরিব ও তাজরীনের মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। রানা প্লাজার মতো বিশ্বকাঁদানো ভবনধস, আসওয়াদ দুর্ঘটনা ও স্ট্যান্
ডার্ড গ্রুপের দশতলা ভবন শ্রমিকদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া। এসবের ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে শত শত কারখানা ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়ায় স্থানান্তর। দুই যুগ ধরে কাজ করা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেরও অর্ডার প্রত্যাহার। অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের কড়াকড়ির পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পুঁজি সঙ্কটে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছেÑ এ দেশের তৈরী পোশাক শিল্প কি পাটের ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে? স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত পাটকেই বলা হতো সোনালি আঁশ। রফতানি আয়ের বড় অংশই দখল করে ছিল পণ্যটি, যে অবস্থা এখন তৈরী পোশাক শিল্পের। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রফতানি বাণিজ্যের ৮১ শতাংশ এখন তৈরী পোশাকের দখলে। সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের দাবিদারও এ শিল্প খাতই। বিবর্তনের সাথে সাথে পাটের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগে খোলা হয় বহু অধিদফতর-পরিদফতর। কিন্তু বিশ্ববাজার ধরে রাখার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে সোনালি আঁশ পরিণত হয় গলার ফাঁসে। পাট ও পাটজাত সব পণ্য মিলিয়েও এখন তেমন কোনো অবদান রাখতে পারছে না রফতানি আয়ে। একে একে বন্ধ হয়ে গেছে বড় পাটকলগুলো। বিজেএমসির অধীনে যেসব কারখানা এখনো ধুঁকে ধুঁকে চলছে, সেগুলোকে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের লোকসান। পানির দরে সরকারি পাটকল কিনে যারা বেসরকারি উদ্যোগে চালাতে চেয়েছিলেন তাদের ক্ষেত্রেও সফলতার গল্প আছে সামান্যই। স্বাভাবিক কারণেই পাটের অভিজ্ঞতায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে তৈরী পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও। ওভেন ও সোয়েটার খাত নিয়ে কাজ করা তৈরী পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ ২০০৮ সালে সারা দেশের ওভেন কারখানার যে তালিকা তৈরি করেছিল তাতে মোট কারখানা ছিল পাঁচ হাজার ৬০৮টি। অতি সম্প্রতি তৈরী তালিকায় চালু কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৭০টি। তাদের হিসাবে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেকেরও বেশি, তিন হাজার ৩৮টি। অব্যাহত শ্রমিক ছাঁটাই, মাসের পর মাস মজুরি বকেয়া পড়া, রাতের অন্ধকারে কারখানার দরজা বন্ধ করে মালিকের পলায়নের মতো অনাকাক্সিত দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে প্রতিদিনই। এ সময়ের মধ্যে নিটওয়্যার কারখানা বন্ধ হয়েছে আরো এক হাজারের মতো। সুতার জন্য হাহাকার করতে করতে বন্ধ হয়ে গেছে হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম সেক্টরের আরো ৬০ হাজার তাঁত। উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) দেয়া তথ্যানুযায়ী, তাদের সংগঠনভুক্ত এক হাজার ৭৬৫টি কারখানার মধ্যে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী মাত্র ৭৭০টি চালু অবস্থায় আছে। বাকিগুলো এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। দামি মেশিনগুলো রক্ষার প্রয়োজনে পোশাকের আরেক উপখাত টেক্সটাইল-স্পিনিং কারখানাগুলো পুরোপুরি বন্ধ করা না হলেও চালু রাখা হয়েছে নামে মাত্র। এ খাতের উদ্যোক্তাদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। দেশের সর্বাধিক ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা ৩৬০টি কমপোজিট টেক্সটাইল মিলের পাশাপাশি দেড় হাজারের মতো উইভিং ফ্যাক্টরির মালিকও এ সংগঠনের সদস্য। তাদের দাবি, লাখ লাখ টন সুতা অবিক্রীত থাকায় টেক্সটাইল মিলগুলো তাদের উৎপাদনক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার করে লোকসান দিয়ে কোনোমতে চালু রয়েছে। বিকল হয়ে পড়ার ভয়ে কোটি কোটি টাকার মেশিন চালু রাখতে গিয়ে তারা তেল পোড়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকার। আর উইভিং মেশিনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেকেরও বেশি। উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের পাশাপাশি সুতার দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় দেশের সম্ভাবনাময় তাঁত শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধানে ব্যর্থ হয়ে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দেড় লক্ষাধিক পাওয়ার লুম। নরসিংদী ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাঁত শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ২৫ লক্ষাধিক লোক এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে অনেক তাঁতি বাধ্য হয়ে বিকল্প কাজের সন্ধান করছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের সাথে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে যারা টিকতে পারছে না তারা এখন এ শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় ভালো অবস্থানে থাকা ভারতীয়রা উঠেপড়ে লেগেছে এর বিরুদ্ধে। কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে একের পর এক নামকরা কারখানা তারা বন্ধ করে দিচ্ছে, আবার কৌশলে কিনেও নিচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের অহঙ্কার এসকিউ, ক্রিস্টাল, মাস্টার্ড, হলিউড, শান্তা, রোজ, ফরচুনা, ট্রাস্ট, এজাক্স, শাহরিয়ার, স্টারলি, ইউনিয়ন প্রভৃতি দেশসেরা গার্মেন্ট কারখানার মালিক এখন ভারতীয়রা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ, আমেরিকান, কানাডিয়ান নাগরিকেরা কিনে নিয়েছেন এসব কারখানা। তৈরী পোশাক শিল্প খাতের একাধিক উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটের পাশাপাশি লাগাতার অস্থিতিশীলতার কারণে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা কিছু দিন আগে থেকেই ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের দিকে ছুটছিলেন। সাভারের ঘটনার পর থেকে এ প্রবণতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান তারা। ুব্ধ উদ্যোক্তারা জানান, নিজ দেশ থেকে কারখানা গুটিয়ে নিয়ে তারা এখন বিদেশে শিল্প স্থাপনে ব্যস্ত। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা ওই সব দেশে শতাধিক কারখানা স্থাপন করেছেন বলেও জানা গেছে। অথচ গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস হয়ে গেলে কেবল এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ২৫ লাখ শ্রমিকই বেকার হয়ে পড়বেন না, দেশে সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসবে বলেও মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুরে নিজস্ব কারখানা বন্ধ করে দিয়ে ভিয়েতনামে যৌথ বিনিয়োগে কারখানা স্থাপনকারী একজন বাংলাদেশী উদ্যোক্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভিয়েতনামও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দেয়া সব সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। ড. ইউনূসের সাথে সরকারের বিরোধ, শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার না হওয়া এবং সর্বশেষ সাভারের ভবনধসের পর জিএসপি হারানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও সব সুযোগসুবিধা হারাতে বসেছে দেশ। তার ওপর প্রতিযোগী দেশগুলোর সরকার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। শ্রমিকের বেতন সামান্য বেশি হলেও সেখানে কোনো ভাঙচুর-লুটতরাজ নেই। তা ছাড়া ভিয়েতনামের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশীদের চেয়ে দামও কিছুটা বেশি পান। সবমিলিয়ে বিনিয়োগের জন্য ভিয়েতনামকে বাংলাদেশের তুলনায় উত্তম স্থান বলেই দাবি করেন তিনি। দেশে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে ুব্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে নমনীয় করা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করার পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হলে দেশের তৈরী পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে রফতানিকারকদের ৪২টি সংগঠন সমন্বয়ে গড়া এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ-গ্যাস নেই। শ্রমিক কিছুটা সস্তা ছিল, সে সুযোগও এখন আর নেই। এমনিতেই চাহিদার তুলনায় দক্ষ শ্রমিকের সঙ্কট রয়েছে ২০ শতাংশ। সাভারের ঘটনায় এ সঙ্কট আরো বেড়ে গেছে। জিএসপি বন্ধের পর থেকে হুমকি আসছে অন্যান্য দেশ থেকেও। বিশ্ববাজারে আমরা এখন চরম ভাবমর্যাদা সঙ্কটে ভুগছি। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বিদেশে কারখানা স্থাপনের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়োপযোগী পদপে গ্রহণের কারণে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামে পোশাক রফতানিতে ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাদের পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ ছিল এবং তাদের সরকার অব্যাহত প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে বলেই তারা এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। এ প্রবণতাকে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের জন্য অশনি সঙ্কেত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
No comments:
Post a Comment