দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও চোখে পড়ার মতো ত্রাণতৎপরতা নেই সরকারের। একই সাথে বানভাসি মানুষের জন্য সরকারের ত্রাণ বিতরণও অপ্রতুল বলে অভিযোগ উঠেছে। বন্যাদুর্গত অনেক এলাকায় গত কয়েক দিনেও ত্রাণ পৌঁছেনি। কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ গেলেও তা পরিমাণে খুবই অপ্রতুল। আর দুর্গম এলাকার বেশির ভাগ পানিবন্দী মানুষ রয়ে গেছেন এখনো ত্রাণতৎপরতার বাইরে। এ দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো কিছু নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
অনেক স্থানে পানিতে ডুবে ফসলের বিশেষ করে আমন ফসলের ব্যাপক তি হয়েছে। সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় পানিবন্দী হয়ে কয়েক লাখ পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব এলাকার অসংখ্য মানুষ গবাদি পশু নিয়ে বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার অনেকে ঘরের মধ্যে বাঁশের মাচা করে রয়েছেন। এসব এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট চলছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহ উল আলম গতকাল মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে বলেছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং হচ্ছে। দুর্গত এলাকার জন্য ইতোমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া স্থানীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের কাছেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণসামগ্রী রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে বরাদ্দ প্রদানের ল্েয মন্ত্রণালয় থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক অনুকূলে তিন কোটি জিআর (খয়রাতি) টাকা এবং ১৩ হাজার টন জিআর চাল ছাড় করা হয়েছে। অধিদফতর িেদশের ৬৪ জেলায় ইতোমধ্যে এক কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার জিআর টাকা এবং আট হাজার টন জিআর চাল বরাদ্দ দিয়েছে। তা ছাড়া তাৎণিকভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য জেলা প্রশাসকদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে। বলতে গেলে সারা দেশে বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণতৎপরতা বেশ জোরেশোরেই চলছে। তিনি বলেন, দেশের বেশ কিছু এলাকায় নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। কিছু এলাকায় অপরিবর্তিত রয়েছে। আবার কিছু এলাকায় নদ-নদীর পানি বাড়ছে। তিনি বলেন, বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেণের জন্য সচিবালয়ে ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। দেশের কোথাও কিছু ঘটলে তা তাৎণিকভাবে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের জানানো হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের নদ-নদীর অবস্থা সম্পর্কে এনডিআরসিসি জানিয়েছে, দেশে মোট ৮৩টি পর্যবেণ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে স্থিতিশীল রয়েছে ২টি, বৃদ্ধি পেয়েছে ৫২টির এবং তথ্য পাওয়া যায়নি একটির। আর পানি হ্রাস পেয়েছে ২৮টির এবং বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১৮টি। গঙ্গা ছাড়া সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় গঙ্গা, ব্র্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা এবং ঢাকা শহরসংলগ্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। এ সময় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। এ দিকে এনডিআরসিসির দৈনিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামালপুরের ৪টি উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের তিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২০০ টন জিআর চাল ও ১১ লাখ টাকা। তিগ্রস্ত লোকদের মধ্যে তাৎণিকভাবে বিতরণ করা হয়েছে ২৪ টন চাল ও পাঁচ লাখ টাকা। ঢাকা জেলায় মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ৩০০ টন চাল ও সাত লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া দোহারে নদীভাঙনে তিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে খাদ্যসহায়তা হিসেবে ৪০ টন চাল এবং চার লাখ টাকা উপবরাদ্দ দেয়া হয়েছে। লালমনিরহাটে মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ২০০ টন চাল ও ছয় লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রাপ্ত এ বরাদ্দ থেকে বন্যা ও নদীভাঙনে তিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসন ৫টি উপজেলায় ১৫৪ টন চাল এবং পাঁচ লাখ ৪২ হাজার টাকা উপবরাদ্দ দিয়েছে। নীলফামারী জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ১৫০ টন চাল ও তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে তিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসন ডিমলা উপজেলায় ১৫ টন চাল ও ৩০ হাজার টাকা এবং জলঢাকা উপজেলায় ৫ টন চাল ও ১৫ হাজার টাকা উপবরাদ্দ দিয়েছে। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ৪০০ টন চাল ও ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রাপ্ত বরাদ্দ থেকে জেলা প্রশাসন ৪টি উপজেলায় মোট ১৬৫ টন চাল ও তিন লাখ ৩৯ হাজার টাকা উপবরাদ্দ দিয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ৫০০ টন চাল ও ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে জেলা প্রশাসন ২৮৬ টন চাল ও তিন লাখ ৯৩ হাজার টাকা উপজেলাগুলোয় বিতরণ করেছে। রংপুর জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ২৫০ টন চাল ও তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে তিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসন গঙ্গাচড়া উপজেলার অনুকূলে ১০ টন চাল ও ৩০ হাজার টাকা এবং কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার অনুকূলে ২ টন করে চাল উপবরাদ্দ দিয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ৪০০ টন চাল ও আট লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে তিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসন ৫টি উপজেলার অনুকূলে ২৪০ টন চাল এবং সাড়ে তিন লাখ টাকা উপবরাদ্দ দিয়েছে। বগুড়া জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ২৫০ টন চাল ও পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে জেলা প্রশাসন ৯০ টন চাল এবং এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা তিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করেছে। নেত্রকোনা জেলায় মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ৫০ টন জিআর চাল ও পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ তিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসন ১৯ টন চাল ও ৩৫ হাজার টাকা উপবরাদ্দ দিয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ৫০ টন চাল ও ছয় লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে জেলা প্রশাসন ৪০ টন চাল ও তিন লাখ টাকা ৫টি উপজেলার তিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করেছে। নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের অনুকূলে ১৫০ টন চাল ও দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে তিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসন ৩০ টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত দেশের ১৮টি পয়েন্টের মধ্যে নীলফামারী জেলার তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এখানে বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গাইবান্ধার ঘাঘট নদীর গাইবান্ধা পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জামালপুর জেলার যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার কমলেও তা বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বগুড়ায় যমুনার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার কমলেও বিপদসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি স্থিতিশীল থাকলেও বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মানিকগঞ্জের যমুনায় আরিচা পয়েন্টে স্থিতিশীল থাকলেও বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের করতোয়া-আত্রাই নদীর পানি বাঘাবাড়ী পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। টাঙ্গাইলের ধলেশ্বরী নদীর পানি এলাসিনঘাটে ২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গাজীপুরে লই্যা নদীর পানি লাখপুর পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মার পানি ২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে পদ্মার পানি ভাগ্যকূল পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শরীয়তপুরের পদ্মায় সুরেশ্বর পয়েন্টে ৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে ২৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জে সুরমার পানি ৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জে পুরাতন সুরমা নদীর পানি দিরাই পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জের যদুকাটা নদীর পানি লরেরগড় পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নেত্রকোনার সোমেশ্বরী নদীর পানি দুর্গাপুর পয়েন্টে ২১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নেত্রকোনার কংশ নদীর পানি জারিয়াজাঞ্জাইল পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার কমলেও বিপদসীমার ১৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment