Wednesday, August 13, 2014

মৌখিক পরীক্ষায় চাকরি পেয়ে তাঁরা বিসিএস কর্মকর্তা!:কালের কন্ঠ

বিসিএস ক্যাডারে চাকরির জন্য তাঁরা কখনো পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মুখোমুখি হননি; কোনো বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি; এমনকি বিভাগীয় পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হননি। শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে পাঁচ বছরের একটি প্রকল্পে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছিলেন তাঁরা। প্রকল্প শেষ হলে তাঁদের চাকরিও শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্প শেষ হয়েছে কিন্তু তাঁরা বনে গেছেন বিসিএস কর্মকর্তা- একদম প্রথম
শ্রেণির স্থায়ী পদে। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা এখন বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়েও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা! দু-চারজন নয়, ৯২ জন শিক্ষককে নিয়ে এমনই তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই ৯২ জন শিক্ষকের সঙ্গে মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অসাধুচক্র যোগসাজশ করে দুর্নীতি-অনিয়মের এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছে। এ-সংক্রান্ত ফাইলটি মাউশির প্রশিক্ষণ শাখা থেকে প্রস্তুত হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন শাখায় সম্পন্ন হয়েছে। এই দুই শাখার অসাধুচক্রটি অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়ে কাজটি করেছে বলে অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ওই শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ীকরণ হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যে বিধিতে হয়েছে তা হয়তো যথাযথ হয়নি। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে নোট পাঠানো হবে। এই নজিরবিহীন অনিয়মের ঘটনায় বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। মাউশির মহাপরিচালকের কাছে তাঁরা স্মারকলিপিও দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৬ জুন জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ১১টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ৯২ জন শিক্ষকের চাকরি বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা মোতাবেক প্রথম শ্রেণির পদে স্থায়ী করেছে। এই শিক্ষকরা ১৯৯৫ সালে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদি ‘মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ‘সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ’ পেয়েছিলেন। তাঁদের নিয়োগের শর্তাবলিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল- ‘প্রকল্প মেয়াদান্তে তাহাদের চাকুরীকাল সমাপ্ত হইবে’। কিন্তু প্রকল্প শেষে ২০০০ সালে বাস্তবতার নিরিখে তাঁদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয় এবং প্রতিবছর ওই পদগুলো সংরক্ষণ করা হয়। পিএসসির সুপারিশের আলোকে ২০১২ সালে তাঁদের চাকরি নিয়মিতকরণ করা হয়। এখন তাঁদের স্থায়ী করা হলো। নিয়োগ পাওয়া ৯২ জন কর্মকর্তার মধ্যে ছয়জন সহকারী অধ্যাপক ও ৮৬ জন প্রভাষক রয়েছেন। এই ৯২ শিক্ষকের চাকরি বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১-এর বিধি ৭(১) ও (২) মোতাবেক স্থায়ী করা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই দুই বিধির আওতায় এই শিক্ষকরা পড়েন না। কারণ ওই দুই বিধিতে চাকরির স্থায়ীকরণের শর্ত হিসেবে কমপক্ষে চার মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং ৩০০ নম্বরের বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সুনির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে, যা এসব শিক্ষক পূরণ করেননি। ওই শিক্ষকদের চাকরি নিয়মিতকরণ পর্যায়ে থাকলে কেবল চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষা হতো, কিন্তু পদোন্নতি হতো না। বিধি লঙ্ঘন করে এই স্থায়ীকরণের ফলে ওই শিক্ষকরা এখন পদোন্নতি ও সিলেকশন গ্রেড পাবেন। পাবেন আর্থিক সুবিধা। বিসিএস ক্যাডারের নিয়মিত কর্মকর্তাদের সিনিয়রিটিতে (জ্যেষ্ঠতা) তাঁরাও দাবিদার হবেন। জানা গেছে, প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া ছয়জন সহকারী অধ্যাপকের চাকরি বিসিএস নিয়োগ বিধিমালায় স্থায়ীকরণ করার ফলে তাঁরা ১৯৮৮ সালে সপ্তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর জ্যেষ্ঠতা পেতে যাচ্ছেন। সাত বছর পর নিয়োগ পেয়েও এখন তাঁরা বিসিএস কর্মকর্তাদের আগেই অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ পাবেন। অথচ তাঁরা কোনো বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি, চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি কিংবা এন্ট্রি পদের (নিয়োগকালীন পদ) পরবর্তী পদে পদোন্নতি লাভের জন্য সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়নি; যা বিসিএস কর্মকর্তাদের করে আসতে হয়েছে। একইভাবে প্রভাষকদের অনেকেই ১৬তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর জ্যেষ্ঠতা পেয়ে যাবেন। স্থায়ীকরণের সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষকরা প্রতিজন অতিরিক্ত প্রায় ৩০ লাখ টাকা করে অবসর সুবিধা লাভ করবেন। এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক সুবিধা দেওয়ার পেছনে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। চাকরি স্থায়ী হওয়াদের একজন বরিশাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক মো. মুহসীন তালুকদার। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, তাঁদের নিয়োগ বিধিসম্মতই হয়েছে। কারণ তাঁদের প্রকল্প প্রস্তাবের নিয়োগবিধিতে উল্লেখ ছিল- প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকদের সরাসরি নিয়োগ বিদ্যমান বিসিএস (সাধারণ) শিক্ষা নিয়োগবিধি অনুযায়ী হবে। বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১-এর বিধির শর্ত অনুযায়ী প্রশিক্ষণ না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারি অতিরিক্ত সচিবের (উন্নয়ন) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে টিচার্স ট্রেনিং কলেজে কর্মরত প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত প্রভাষকদের পর্যায়ক্রমে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তা আর করা হয়নি। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য তাঁরা এখন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবেন। ওদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপন জারির পর বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গত ১৩ জুলাই সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ৬৭ জন শিক্ষক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে ওই প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই সরকারি বিসিএস বিধিমালা ১৯৮১ অনুযায়ী স্থায়ীকরণ করার ঘটনা নজিরবিহীন। এর কুপ্রভাব পড়বে গোটা শিক্ষা ক্যাডারে। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যাঁরা চাকরি করে আসছেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাসুমে রব্বানী বলেন, ‘ওই শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ীকরণ নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারে তাঁদের স্থায়ী করার সুযোগ আছে কি না সেটাই প্রশ্ন। বিসিএস নিয়োগ বিধিমালায় এই সুযোগ নেই।’ এ ব্যাপারে শিক্ষাসচিব ড. মোহাম্মদ সাদিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান।

No comments:

Post a Comment