এক হাজার ১২০ কোটি টাকা খরচ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে যন্ত্রপাতি কিনে দেবে, না ঠিকাদার নিজে যন্ত্রপাতি কিনে পণ্য পরিবহন করবেন—এমন রশি টানাটানিতে প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। বিশাল এই কেনাকাটা নিয়ে মতবিরোধের কারণেই দেশের সবচেয়ে বড় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি (এনসিটি) চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। ইতিমধ্যে এই কেনাকাটার জন্য তিনবার দরপত্র আহ্বান ও তা বাতিল হয়েছে। বন্দর তহবিল থেকে এই কেনাক
াটার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রী চিঠি দিয়ে বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছেন বলে শুনেছি। এই দরপত্র এখনই বাতিল করা উচিত। আমাদের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে কোথাও কোনো ক্রয়ের সুযোগ পেলেই সেটিই প্রথম গ্রহণ করি। এখানে সেই প্রবৃত্তিই প্রকট রূপ লাভ করেছে।’ প্রায় ৫৬৬ কোটি টাকা খরচ করে টার্মিনালটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ২০০৭ সালে। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, খালি পড়ে থাকায় টার্মিনালের জেটিগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বন্দরসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, এটি পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যত দেরি হবে, ততই আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বিপদের মুখে পড়ার শঙ্কা আছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরের টাকায় যন্ত্রপাতি কিনে এটি যত শিগগির সম্ভব চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আরও বলেন, অর্থমন্ত্রী বা সংসদীয় কমিটি এর আগে বন্দরের টাকায় যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি অনুমোদন করেছিলেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয়ের সব বড় প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে হয়ে থাকে। অর্থমন্ত্রী চিঠির প্রসঙ্গ তোলা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। কার টাকায় যন্ত্রপাতি: বন্দরের টাকায় ৬১ ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সেগুলো দিয়ে বাইরের ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করানোর পক্ষে নৌমন্ত্রী ছাড়াও বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ। বেসরকারি বার্থ অপারেটররাও চাইছে তাদের যন্ত্রপাতি কিনে দেওয়া হোক। বন্দর কর্তৃপক্ষের যুক্তি, এক হাজার ১২০ কোটি টাকায় ঠিকাদারকে যন্ত্রপাতি কিনে দিয়ে টার্মিনালটি চালু করলে বন্দর বছরে প্রায় ৮৮৭ কোটি টাকা লাভবান হবে। বন্দর চেয়ারম্যান এমন একটি হিসাব গত ২১ আগস্ট সংসদীয় কমিটির সভায় দিলেও তা নিয়ে সন্দেহ ও বিরক্তি প্রকাশ করেন কমিটির সদস্যরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বন্দরের চেয়ারম্যান বলেন, ওই হিসাবটি আরও বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। দরপত্র আহ্বানের পর ঠিকাদার কত দর দেবে, তার ওপর নির্ভর করবে যন্ত্রপাতি কিনে ঠিকাদার দিয়ে পরিচালনা করলে বেশি লাভ হবে, না ঠিকাদার যন্ত্রপাতি কিনে পরিচালনা করলে বেশি লাভ হবে। এদিকে সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ কার্যবিবরণী অনুযায়ী কমিটির সদস্য এম আবদুল লতিফ বলেন, ‘বিনা কারণে, বিনা প্রয়োজনে ঠিকাদারকে বন্দর কর্তৃক যন্ত্রপাতি কিনে দেওয়া সমীচীন হবে না।’ তিনি বন্দরের দেওয়া তুলনামূলক হিসাব পরীক্ষা করা এবং বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়ার পরামর্শ দেন। পক্ষপাতিত্ব ও সিদ্ধান্তহীনতা: ২০০০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বেসরকারি অপারেটর যন্ত্রপাতি কিনে টার্মিনাল পরিচালনা (এসওটি পদ্ধতি) করবে। ২০০৮ সালের দরপত্রে চারটি বিদেশি অপারেটরকে নির্বাচিত করা হলেও ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদীয় কমিটির সুপারিশে বন্দর কর্তৃপক্ষ দরপত্র বাতিল করে। এরপর দফায় দফায় প্রাক্যোগ্যতার দলিলপত্র সংশোধন করার পর দেশীয় সাইফ পাওয়ারটেক ও বিদেশি পিএসএ ইউরোপ নামের আরও দুটি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের বিরুদ্ধে তৎকালীন বন্দর চেয়ারম্যানসহ মূল্যায়ন কমিটির তিন সদস্য আপত্তি দেন। স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘...এই দরদাতাকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ করা হয়েছে।’ ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় মূল দরপত্রে পাঁচটি দেশি-বিদেশি যৌথ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তবে দরপত্রের শর্ত সংশোধন ও বিলোপ করে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার পাঁয়তারা বুঝতে পেরে দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান বন্দর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং ক্রয়সংক্রান্ত কারিগরি ইউনিটের (সিপিটিইউ) কাছে প্রতিকার চেয়ে তারা আবেদন করে। এরপর আগের চারটি প্রতিষ্ঠানকে বহাল রেখে মূল দরপত্র শুরু করার নির্দেশনা দেওয়া হলে এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে সাইফ পাওয়ারটেক। আদালত তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেন। এরপর সংসদীয় কমিটির ৩৮তম সভায় বন্দরের অর্থায়নে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে এনসিটি পরিচালনার সুপারিশ করা হয়। এ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য দ্বিতীয় দফায় দরপত্র বাতিল করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নৌ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এরপর বন্দর নিজের টাকায় টার্মিনাল পরিচালনার যন্ত্রপাতি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করলেও নতুন সরকারের সংসদীয় কমিটিতে পরিবর্তন আসে। কমিটি ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল প্রথম সভায় সিদ্ধান্ত নেয়, বেসরকারি অপারেটররাই যন্ত্রপাতি কিনে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। তার পরও বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরের টাকায় যন্ত্রপাতি কেনার পর বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনা হলে পুরো নিয়ন্ত্রণ বন্দরের হাতে থাকে। এ নিয়ে আপত্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাহলে অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে কেনাকাটার প্রক্রিয়া করা হোক। বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণে এই টার্মিনাল পরিচালনার ভার দেওয়া উচিত হবে না বলে মত দেন তিনি। তবে সংসদীয় কমিটি সূত্র মনে করছে, বিপুল অর্থের এই কেনাকাটার পেছনে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র রয়েছে।
No comments:
Post a Comment