Tuesday, September 16, 2014

চাকরির পর জমা দেয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হতে পারে:নয়াদিগন্ত

সরকারি নিয়মানুযায়ী, চাকরিতে যোগ দেয়ার সময়ই মুক্তিযোদ্ধার সনদ জমা দেয়ার কথা। সেটি হয়নি। সম্প্রতি সরকারের চার সচিব ও এক যুগ্মসচিবের সনদ জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর সরকারের টনক নড়ে। চাকরিতে যোগ দেয়ার পর যেসব কর্মচারী চাকরির বয়স বাড়াতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জমা দিয়েছেন, প্রত্যেকের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। চাকরির পর জমা দেয়া সব মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করার বিষয়টি চিন্তা করছে সরকার। এ ব্যাপারে শিগগির ঘোষণা আস
তে পারে বলে জনপ্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। যারা ভুয়া সনদ দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়েছেন, তাদের সুবিধাও কেড়ে নেয়া হতে পারে বলে কর্মকর্তারা জানান। পাশাপাশি রয়েছে বিভাগীয় শাস্তি। চাকরিতে যোগ দেয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধার সনদ জমা দেয়ার নিয়মটি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মানলেও পরে বিগত মহাজোট সরকারের আমলে এর ব্যত্যয় ঘটে। ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। পরে ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণ করা হয়। অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর পর থেকে একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জোগাড়ের হিড়িক পড়ে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অবসরের বয়স বাড়ানোর পর প্রায় ২১ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রত্যয়নের জন্য এ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অতিরিক্ত রোজগারের আশায় সনদ জালিয়াতির জন্য তারা স্বাধীনতার প্রায় ৪২ বছর পর মেতে ওঠে। বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের নজরে এলেও রাজনৈতিক কারণে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান বলে কর্মকর্তারা জানান। সনদ নেয়া বেশির ভাগই সরকারদলীয় সমর্থক বলে পরিচিত। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময় যারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে ঘোষণা এবং মুক্তিযোদ্ধা সনদ জমা দিয়েছেন তারা মর্যাদা পাবেন। সমস্যা ২০১০ সাল থেকে। চাকরির বয়স বাড়াতে গিয়ে অনেকেই অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। ২১ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে প্রায় সাত হাজার সনদেই গলদ পায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সেগুলো প্রত্যয়ন করেনি। দীর্ঘদিন ধরে এ প্রক্রিয়া চলে এলেও ভুয়া সনদধারী কারো বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শুধু সরকারি কর্মচারী নয়, সরকারি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের মুক্তিযোদ্ধা সনদেও গলদ ধরা পড়েছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের েেত্র ১৫২ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ সঠিক নয় বলে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এক হাজার ৬৬৮ জনের সনদে জালিয়াতি ধরা পড়ে। গত পাঁচ বছরে ১১ হাজার ১৫০টি সনদ ইস্যু করা হয়েছে। এ দিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ১৮২ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে। মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের রোববারের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, লাল মুক্তিবার্তা ও ভারতের কাছ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ তালিকার এক লাখ ৪৪ হাজার ছাড়া বাকিদের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। তবে বাতিল হওয়া সনদধারীরা আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত আপিল করতে পারবেন। মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই-বাছাইয়ের পর আগামী ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করে তাদের পরিচয়পত্র দেয়া হবে। কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার ৪২ বছর পার হলেও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংজ্ঞা এখনো কোনো সরকার নির্ধারণ করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে ১১ ক্যাটাগরির ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার খসড়া চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। জামুকার আগামী বৈঠকে তা অনুমোদন করা হতে পারে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণসংক্রান্ত সাবকমিটি ইতোমধ্যে দু’টি বৈঠক করেছেন। এ সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেনÑ সাবেক সচিব মো: রশিদুল আলম ও মেজর (অব:) ওয়াকার হাসান। কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জামুকার মহাপরিচালক। কমিটি গত ২৪ আগস্ট ও ৯ সেপ্টেম্বর দু’দফায় বৈঠকে মিলিত হয়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য আবেদনকারীদের যুদ্ধের সময়ের বয়স কমপে ১৫ বছর হতে হবে বলেও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময় যাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছিল না বা যারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেয়নি তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন না। প্রসঙ্গত দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পর চার সচিব ও এক যুগ্ম সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ও দিকে রোববার চার সচিব ও এক যুগ্ম সচিবের মুক্তিযুদ্ধ সনদ বাতিল হওয়ার পর গতকাল সোমবার সচিবালয়ে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে আতঙ্কিত অবস্থায় দেখা গেছে। তাদের অনেকেই চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সনদ জমা দিয়েছেন। যুগ্ম সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, সনদ অনিয়মের কারণে যেখানে সচিবপর্যায়ের কর্মকর্তারা পার পাননি, সেখানে অন্যদের রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া ওই কর্মকর্তা জানান, প্রত্যেকের সনদ পরীক্ষা করে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এতে প্রশাসনে পদোন্নতি জটিলতাও অনেকটা কমে আসবে। সনদ জালিয়াতি করে ওপরের পদে বসে থাকা কর্মকর্তাদের কারণে নিচের স্তরের কর্মকর্তারা পদোন্নতি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া অনেকেই ভালো পোস্টিংও পাচ্ছেন না।

No comments:

Post a Comment