Tuesday, September 23, 2014

গণজাগরণ মঞ্চে গৃহদাহ:নয়াদিগন্ত

সুনির্দিষ্ট ছয় দফা দাবি নিয়ে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে উদ্ভব হয়েছিল বহুলালোচিত গণজাগরণ মঞ্চের। ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের (বোয়ান) ব্যানারে যাত্রা শুরু হয় দেশে-বিদেশে তুমুল আলোড়ন তোলা এ মঞ্চটির। শুরুর দিকে শাহবাগে লাখ লাখ লোকের আগমন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এরপর ১ বছর ৭ মাস ১৫ দিন পার হয়েছে। কিন্তু সেই বিশাল জনতার মঞ্চ এখন আর নেই। মঞ্চের নেতাকর্মীরা ভাগ হয়েছেন চার অংশে
। এর মধ্যে তিনটি অংশ আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করলেও সদস্যের চেয়ে অধিক উপস্থিতি মিডিয়াকর্মীর। কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে তিন অংশের মধ্যে সংঘর্ষও এখন নিত্য ঘটনা। মূল দাবির তুলনায় বিবদমান অংশগুলোকে এখন পরস্পর বিষোদগারেই বেশি সময় ব্যয় করতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে গৃহদাহে বিধ্বস্ত গণজাগরণ মঞ্চ। মূল দাবি থেকে অনেকটাই বেরিয়ে অনিয়ম আর মুখপাত্র নিয়ে বিরোধে এখন টালমাটাল আলোচিত এ সংগঠনটি। চার অংশের মধ্যে দু’টি অংশ শুরু থেকেই মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনকারী ইমরান এইচ সরকারকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অর্থ আত্মসাৎ, স্বেচ্ছাচারিতা, একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এক কেন্দ্রিকতাসহ অসংখ্য অভিযোগ।  বেশ কিছুদিন নীরব থাকার পর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের পর আবারো আলোচনায় গণজাগরণ মঞ্চ। তবে এবার দাবির তুলনায় দ্বন্দ্বই অধিক প্রকাশ পেয়েছে। গত শুক্রবার মঞ্চের ত্রিমুখী সংঘর্ষের পর ইমরানপন্থী অনেক নেতাকে ছাত্রদল-শিবির বলেও আখ্যা দেয়া হয়েছে। আন্দোলনের শীর্ষ সংগঠকরাই এখন ইমরানবিরোধী। তবে ইমরানপন্থীরাও বসে নেই। তারা প্রতিপক্ষ ও সরকারের কঠোর সমালোচনার লিপ্ত। জানা যায়, প্রথম থেকেই জাসদ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি হোসাইন আহমেদ তাফসীর আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে অজানা কারণে কয়েক মাস পরেই তিনি মঞ্চ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এ ছাড়া বাপ্পাদিত্য বসু, তানভীর রুসমত, শামসুল ইসলাম সুমনসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা ইমরানকে সমর্থন দিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন। মঞ্চ নিয়ে অভিযোগের ঝড় উঠলেও তারা সরে যাননি। তখন সমালোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু একপর্যায়ে ইমরানসহ নেতাদের সমালোচনা প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। প্রকাশ পায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী ও জাসদ ছাত্রলীগের মতো সংগঠনগুলোর প্রভাব। পরে ছাত্রলীগ মঞ্চ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলে শুরু হয় অচলাবস্থার। ইমরান সরকারও একাধিকরার দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অনিয়মের কারণে সাধারণ সমর্থকেরাও মুখ ফিরিয়ে নেয় মঞ্চ থেকে। এভাবেই এক বছর ঢিমেতালে চলেছে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। এ বছর ২৬ মার্চ আবারো আলোচনায় আসে গণজাগরণ মঞ্চ। এটিকে মঞ্চের ভাঙনের সূত্রপাত বলেও মনে করছেন অনেকে। সে দিন শাহবাগে সমাবেশ করার জন্য মঞ্চ তৈরি করে তারা। যেখানে জাতীয় পতাকা অবমাননা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে কর্মসূচি-পাল্টা কর্মসূচিও চলে। তখন এ অভিযোগ অস্বীকার করে ইমরান এইচ সরকার গণমাধ্যমে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীরা বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। যা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে ৫ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগ ইমরানকে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়। একই দিন দুপুরে ইমরান এবং তার সঙ্গীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সংবাদ সম্মেলন করে। ওই দিন তারা ৩ ও ৪ এপ্রিল তাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা এবং মামলার জন্য ইমরানকে দায়ী করেন। পরে গত ৮ এপ্রিল গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক অবস্থানের কারণে গণজাগরণ মঞ্চে ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন মঞ্চের সাথে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ পাঁচ বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তখন থেকেই ইমরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু পৃথকভাবে শাহবাগে আন্দোলন কর্মসূচি পালন শুরু করেন। এরপর গত ১২ এপ্রিল ইমরানকে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রের পদ থেকে অব্যাহতি দেয় মঞ্চের একাংশ। এ দিন থেকে নতুন একটি অংশ সৃষ্টি হয়, যার নেতৃত্ব আছেন কামাল পাশা। এ অংশটি সরকার সমর্থক অংশ হিসেবে পরিচিত। ১৮ এপ্রিল শাহবাগে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে ইমরান ও পাশাপন্থী গণজাগরণ মঞ্চের দুই অংশ। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে সঙ্ঘাতের আশঙ্কায় পুরো এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। মঞ্চের সর্বশেষ অংশটির সৃষ্টি ১৯ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে। এ অংশটি ইমরানকে মঞ্চের মুখপাত্রের পদ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো অব্যাহতি দেয়। এ অংশটিই হলো আন্দোলনের সূচনাকারী ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান)। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের তুমুল আলোচিত গণজাগরণ মঞ্চ এখন চার ধারায় বিভক্ত। বোয়ান ছাড়া বাকি তিন অংশই নিয়মিতভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। তবে সব অংশেরই কর্মী সংখ্যা হাতেগোনা। মঞ্চের বিবদমান তিন অংশের মধ্যে এখন সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাহবাগে মঞ্চের যে মিডিয়া সেন্টারটি তৈরি করা হয় সেটি এখন কামাল পাশাপন্থী অংশের দখলে। জাদুঘরের মূল ফটকের বাম দিকে আর একটি মিডিয়া সেন্টার তৈরি করেছে ইমরানপন্থীরা। গত কয়েক মাস গণজাগরণ মঞ্চের তেমন কোনো কর্মসূচি ছিল না। ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার রায়ে সাজা কমানোর পর থেকে আবার সরব হয় গণজাগরণ মঞ্চ। রায়ের দিন তিন অংশই আলাদা কর্মসূচি পালন করে। এ দিন দুই অংশের সাথে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ইমরানসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। পরে গত শুক্রবার গণজাগরণ মঞ্চে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত শনিবার মঞ্চের পাঁচটি ছাত্র সংগঠনের অংশের মুখপাত্র বাপ্পাদিত্য বসু বলেন, ইমরানের স্বেচ্ছাচারিতা ও এককেন্দ্রিকতার কারণে গণজাগরণ মঞ্চের অন্য অংশগুলোর উদ্ভব। এ ছাড়া তার সাথে ছাত্রদল ও শিবির রয়েছে। যাদের উস্কানিতে মঞ্চে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এদেরকে বাদ দিয়ে দিলেই মঞ্চের ঐক্য ফিরে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রায় একই ধরনের মন্তব্য অপর অংশের মুখপাত্র কামাল পাশারও। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার মনে হয় ওই অংশের মধ্যে বাইরের কেউ এসে ইন্ধন জোগাচ্ছে। যে কারণে এই অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো ঘটছে। ঐক্য স্থাপনের উদ্যোগেও ব্যাঘাত ঘটছে। তবে আমরা সব সময় প্রস্তুত আছি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। এ বিষয়ে জানতে ইমরান এইচ সরকারের মোবাইলে ফোন দেয়া হলে তার একজন সহকর্মী ফোনকলটি রিসিভ করেন। তিনি ইমরানের পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, গণজাগরণ মঞ্চের মধ্যে কোনো ভাঙন নেই। এর একটিই ভাগ। শুরু থেকেই যারা ছিলেন তারা এর সাথে আছেন। সরকার সমর্থক একজন এখান থেকে একটা বেনিফিট নেয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, এটা কোনো রাজনৈতিক মঞ্চ না। এখানে যারা আছেন সবাই সাধারণ কর্মী। তবে ছাত্রজীবনে কে কী ছিল সেটা কোনো ধর্ত্যব্যের বিষয় না। আর একসময় কোনো কিছুর সাথে জড়িত থাকলেও এখন সাধারণ কর্মী হিসেবেই আছেন।

No comments:

Post a Comment