ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতচক্রের ব্যাপক তৎপরতার পর ভর্তি পরীক্ষায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা মোজাম্মেল হক লেনিনের আটকের পর শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল কর্তৃপক্ষ তার ব্যবহৃত ২২১ নম্বর রুমে অভিযান চালায়। এ সময় সে
খান থেকে পুলিশের সহায়তায় আটক করা হয়েছে আরো দু’জনকে। আটককৃতরা হলেন সজীব ও সাদ্দাম। এরা দু’জন দীর্ঘ দিন ধরে লেনিনের সহযোগী হিসেবে হলে অবস্থান করছিল বলে একাধিক ছাত্রলীগ নেতা জানান। অভিযান শেষে রাতেই রুমটি সিলগালা করে দেয়া হয়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায় আটককৃতদের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা দায়ের করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতচক্রের ব্যাপক তৎপরতার পর পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এ নিয়ে বেশ চাপে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সে কারণে শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য পদ্ধতি সামনে রেখে শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকেরা বৈঠকে বসবেন। সেখানে সম্ভাব্য যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে, একাধিক শিফটে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই পরীক্ষা নেয়া, বাইরের কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করা, মেটাল ডিটেক্টর এবং স্ক্যানার ব্যবহার, ভর্তির ধরনে পরিবর্তন ইত্যাদি। এ ছাড়া নিয়ম করা হতে পারে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর এক বছরই ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার। বর্তমানে সর্বশেষ দুই বছরের এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়ক এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, জালিয়াতচক্রের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জিরো টলারেন্সে চলে এসেছে। এ বিষয়ে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। যারা আটক হয়েছে তারা যাতে বের হতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া সামনের বছর থেকে নতুন নিয়মে পরীক্ষা নেয়া হতে পারে। এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে শিগগিরই সভা ডাকা হবে বলে জানান ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ বলেন, ভর্তি জালিয়াতি রোধে অনেক বিষয় সামনে রেখে আলোচনা চলছে। শিগগিরই ভিসি স্যার এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন। আগামী বছর থেকে নতুন কোনো নিয়মে পরীক্ষা নেয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। লেনিনের আলিশান রুম : রুমের মাঝামাঝি একটি ওয়ারড্রব। সাথেই একটি ফার্নিচারের কম্পিউটার টেবিল। এক পাশে দামি বক্স খাটের সাথে রয়েছে তোশক। রয়েছে মূল্যবান জাজিম এবং আরাম কেদারা। অনেক পোশাক-আশাক রুমজুড়ে। একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার উদ্ধার করা হয়েছে। সাথে রয়েছে আরো একটি খাট এবং টেবিল। ব্যাপক সাজসজ্জার পাশাপাশি রয়েছে একটি বড় সাইজের টেলিভিশন। যা হলের টিভির তুলনায়ও অনেক বড়। এমনই আলিশান রুমে থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোজাম্মেল হক লেনিন। যিনি বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা জালিয়াতির ঘটনায় বিশাল এক চক্রের সাথে র্যাবের জালে আটক হয়েছেন। তবে গতকাল দুপুরে গিয়ে টেলিভিশনটি রুমে আর পাওয়া যায়নি। হলের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, সকালে কয়েকজন তার রুমের পেছনের দরজা খুলে সেটি বের করে নিয়ে গেছে। লেনিনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : ভর্তি জালিয়াতি ছাড়াও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোজাম্মেল হক লেনিনের বিরুদ্ধে। হল শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, ২০১১ সালে হলের টিভি রুমে তুচ্ছ ঘটনায় ব্যাপক সংঘর্ষের অন্যতম হোতা ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে হল শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার এক মাস আগে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। যেদিন তার নেতৃত্বে হলের ১৩টি রুমে ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়। তারা আরো জানান, লেনিনের রুমে তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে প্রায়ই মদের আসর বসত। এ ছাড়া চাঁদাবাজি ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি একটি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পান তিনি। নিয়োগ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যেই তিনি বদলি হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি নিয়েও বিতর্ক। এ ছাড়া বিভিন্ন অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও হয়েছেন। তারপরও স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনা শেষ করে রহস্যজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি দারুস সালাম শাকিল নয়া দিগন্তকে বলেন, ছাত্রলীগের জন্য একটি সমস্যার নাম ছিল লেনিন। সে হলের যত সমস্যা ছিল তার সবকিছুতেই জড়িত থাকত। তার কারণে ছাত্রলীগ কখনো স্বস্তিতে থাকতে পারেনি। হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. বায়তুল্লাহ কাদেরী নয়া দিগন্তকে বলেন, লেনিন বর্তমান হলের বৈধ ছাত্র নয়। তবে সে হলের একটি রুম ব্যবহার করত। ভর্তি জালিয়াতির ঘটনায় তার ব্যবহৃত রুম থেকে দু’জনকে আটক করে রুমটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। সে হলে থাকাকালে বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল। একবার তাকে হল থেকে বহিষ্কারও করা হয় বলে তিনি জানান। ১৬টি মামলা : জালিয়াতির ঘটনায় আটককৃতদের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা এস এম কামরুল আহসান বাদি হয়ে মামলাগুলো দায়ের করেছেন। এর মধ্যে লালবাগ থানায় ৫টি, রমনা থানায় ২টি, বংশাল থানায় ১টি, চকবাজার থানায় ১টি, মতিঝিল থানায় ১টি, খিলগাঁও থানায় ১টি, মিরপুর থানায় ২টি, ওয়ারি থানায় ১টি, মোহাম্মদপুর থানায় ১টি এবং শেরেবাংলা নগর থানায় ১টি। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমাদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ভর্তি পরীক্ষার নিয়মের পরিবর্তনের সাথে সাথে জালিয়াতচক্র কৌশলও পাল্টাচ্ছে। আগামীতেও তাদের তৎপরতা থাকবে। তবে এবার একটি ইউনিটের নিয়ম পরিবর্তন বেশ কাজে দিয়েছে। সামনের বছরও এ বিষয়ে যাতে কোনো ধরনের জালিয়াতি না ঘটে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
No comments:
Post a Comment