Tuesday, October 14, 2014

৪৮ মিল বিক্রিতেই লতিফের অনিয়ম:কালের কন্ঠ

১৯৮২ সাল থেকে শুরু করে গত ৩২ বছরে রাষ্ট্রীয় খাতের মোট ১৩৪টি পাট ও বস্ত্রকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে গত মহাজোট সরকারের আমলে কেবল আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরেই বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয় ৪৮টি কলকারখানা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর সবগুলোর হস্তান্তরপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে। এর মধ্যে তিনটি কারখানার শুধু জমির মূল্যই প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা; অথচ শিল্পপ্র
তিষ্ঠানগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে পানির দরে। গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর লতিফ সিদ্দিকীর আমলে দেওয়া ৪৮টিসহ শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারের অধীনে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া ৭০টি মিলের অস্তিত্বই এখন আর বাস্তবে নেই; আছে শুধু কাগজে-কলমে। ওই সব মিলের জমিতে এখন হাউজিংসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলি, পাহাড়তলীতে অবস্থিত ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলটি ১৯৭২ সালে জাতীয় করা হলেও ১৯৮৫ সালে আগের মালিক তাহের গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ জন্য এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা সরকারকে পরিশোধের শর্ত দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন তাহের গ্রুপ সরকারের টাকা পরিশোধ না করায় দায়দেনার পরিমাণ সুদে-আসলে দাঁড়ায় ছয় কোটি ৬২ লাখ টাকা। কিন্তু তাহের গ্রুপের পক্ষে সুলতানা রশিদ তাঁদের এলাকার জামাই তৎকালীন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর আমলে মন্ত্রণালয়ে দায়দেনা মওকুফের আবেদন করেন। তখন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এই মর্মে নোট দেওয়া হয় যে, ওই দায়দেনা মওকুফের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের নেই। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে মতামত নিতে হবে। মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর কাছে নথি গেলে তিনি নথিতে লিখিত সিদ্ধান্ত দেন যে, এই মিলের দায়দেনা সরকার কর্তৃক মালিকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সঠিক হয়নি। তাই মূল অর্থ এবং সুদ মওকুফ করা যায়। মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর এমন সিদ্ধান্তের পর ছয় কোটি ৬২ লাখের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ কোটিরও বেশি টাকা মওকুফ করে ওই বেসরকারি মালিকের কাছ থেকে মূল পাওনা মাত্র এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা সাত দিনের মধ্যে আদায়ের সময় দিয়ে আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু ওই টাকাও এখনো সরকারি কোষাগারে আসেনি। অথচ মিলটি ভোগ দখল করে যাচ্ছেন ওই বেসরকারি মালিক। মিলটি ২০০১ সাল থেকে বন্ধ আছে এবং এর শেডগুলো গোডাউন হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে বেসরকারি মালিকপক্ষ লাখ লাখ টাকা আয় করছে। সদ্য অপসারিত মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর আগের আমলে এ রকম অনিয়মের নজির আরো রয়েছে। গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে এক বৈঠকে অনিয়ম ও চুক্তি লঙ্ঘন করে যেসব রাষ্ট্রীয় কলকারখানা বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়েছে, সেগুলো আবার সরকারের অধীনে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন।   জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা সরকারের কাছ থেকে কিনেও চুক্তি লঙ্ঘন করে মিলগুলো এখনো চালু করেনি, সেগুলোর বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছি। আশা করি, সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা পেলে খুব তাড়াতাড়ি এ মিলগুলো সরকারের অধীনে ফিরিয়ে আনতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর আমলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া মিলগুলোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেআইনিভাবে হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে আইন মন্ত্রণালয় থেকেও দুটি মিলের বিষয়ে বলা হয়েছে, ওই সময়ের বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া ছিল আইনবহির্ভূত। ওই মিলগুলো ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।’ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া ৩৮টি বস্ত্রকল, ৩৫টি পাটকলসহ মোট ১৩৪টি কলকারখানার মধ্যে এখন ৭০টির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে ১৬টি মিল হস্তান্তর করেছে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন। হস্তান্তরের সময় শর্ত ছিল মিলগুলো তারা সরকারের কাছ থেকে নিয়ে আবার চালু করবে। কিন্তু তারা তা না করে মিলের যন্ত্রপাতিসহ মালামাল বিক্রি করে মিলগুলোকে অন্য কাজে লাগিয়েছে। অনেক স্থানে মিলের সাইনবোর্ড পর্যন্ত বেসরকারি মালিকরা সরিয়ে ফেলেছেন। তবে মিলগুলো যে জমিতে স্থাপিত হয়েছিল সে জমির দাগ-খতিয়ান মন্ত্রণালয়ের কাছে রক্ষিত আছে বলে এখনো ওই মিলগুলো বা মিলের জমিগুলো যেখানে যে অবস্থায় আছে, সেভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময়ে (২০০৯-১৩) বিশালাকারের তিনটি বস্ত্রকলসহ পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন ৪৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়। তখন এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিটিএমসির আটটি, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুটি, শ্রমিক-কর্মচারীদের ব্যবস্থাপনায় হস্তান্তরিত তিনটি, লিকুইডেশন সেলের মাধ্যমে বিক্রীত তিনটি, বিজেএমসির একটি এবং বিজেসির (এখন বিলুপ্ত) ৩১টিসহ মোট ৪৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ ও হস্তান্তর করা হয়। এগুলো হস্তান্তরে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। এর মধ্যে একেকটি মিল সরকারের জন্য মহামূল্যবান সম্পত্তি হলেও মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কোনো পরামর্শের তোয়াক্কা না করেই তিনি একক সিদ্ধান্তে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর আমলে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ‘বেসরকারীকরণ নীতিমালা ২০০০’ জারি হওয়ার পরও তা লঙ্ঘন করে হস্তান্তর করা হয়েছে। জানা গেছে, এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে হস্তান্তরে মন্ত্রিসভা কমিটির বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফেনী জেলার রানীর হাটের দোস্ত টেক্সটাইল মিলটি লোকসানের কারণে বন্ধ আছে। এ মিলের ২১.৪৭ একর জমির মধ্যে ১২.৭১ একর জমি উদ্বৃত্ত হিসেবে চিহ্নিত করে বিক্রির জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয় ২০০৭ সালে। তখন এ জমির মূল্য ওঠে মাত্র দুই কোটি ৭১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। কিন্তু পরবর্তী সাত বছরে আর কোনো টেন্ডার না করেই লতিফ সিদ্দিকীর আমলে ২০১৩ সালে দোস্ত মিলের ওই জমি ২০০৭ সালের দরদাতাদের কাছে ওই মূল্যেই হস্তান্তরের আদেশ দেন লতিফ সিদ্দিকী। কিন্তু ওই টাকাও এখনো পরিশোধ করতে পারেননি বেসরকারি মালিকরা। এভাবে লতিফ সিদ্দিকী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন সারা দেশে ‘যেখানে যে অবস্থায় আছে’ ভিত্তিতে একাই সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে গেছেন। এসব নতুন বেসরকারি মালিকের অনেকেই এখন কম দামে নেওয়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান রক্ষায় অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি মোতাবেক দেনা পরিশোধসহ অন্যান্য শর্ত যাতে মানতে না হয় সে জন্য উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন সরকারের বিরুদ্ধে। অনেকে আবার আদালতের রায়ও নিজেদের পক্ষে পেয়েছেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি টেক্সটাইল ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার (টিএফসি) ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০০ সালে ভ্যালুয়ার ফার্ম চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট কর্তৃক এ প্রতিষ্ঠানের তিন বিঘা জমিসহ স্থায়ী সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করা হয় আট কোটি ৪৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। ২০০৩ সালে একটি টেন্ডারেও এ প্রতিষ্ঠানের শুধু জমির মূল্যই ওঠে সাত কোটি ১০ লাখ টাকা। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী তাঁর মন্ত্রিত্বের সময়ে ২০১১ সালের ২৪ মে প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণকৃত জমির তৎকালীন মালিকদের ডেকে এনে মাত্র ৫৯ লাখ টাকার বিনিময়ে তাঁদের কাছে হস্তান্তর করেন। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে অবস্থিত ১০.০৬৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ভালিকা উলেন মিলস লিমিটেডে উলেন পোশাক, মোজা, কম্বল ইত্যাদি তৈরি হতো। ২০১২ সালের ২৫ মার্চ মিলটি বেসরকারীকরণের জন্য প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের ১০.০৬৭ একর জমির মধ্যে ৩.৯০ একর বিটিএমসি উদ্বৃত্ত ঘোষণা করলেও জমিটি বেসরকারি খাতে হস্তান্তর না করার জন্য অর্থমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর সেই অনুরোধও রাখা হয়নি। এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জমিটি মেসার্স স্মার্ট জোনসের কাছে দলিল করে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে বিলুপ্ত বাংলাদেশ জুট করপোরেশনের (বিজেসি) ১১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কয়েক শ একর জমি বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করে গেছেন সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। তাঁর আমলে মেয়াদোত্তীর্ণ লিকুইডেশন সেলের মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে বড় তিনটি বস্ত্রকল- কুষ্টিয়ার মোহিনী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, গাজীপুরের মসলিন কটন মিলস লিমিটেড ও কুমিল্লার চিশতী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড নামমাত্র মূল্যে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করে গেছেন তিনি। অথচ এ তিনটি কারখানার শুধু জমির মূল্যই প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বলে জানা গেছে।

No comments:

Post a Comment