Monday, January 19, 2015

সড়ক যোগাযোগ কার্যত অচল:প্রথম অালো

দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষাকারী বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১২ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এগুলোর বেশির ভাগই গণপরিবহন। কিন্তু ৬ জানুয়ারি থেকে অবরোধ শুরুর পর যানবাহন চলাচলের পরিমাণ নেমে এসেছে অর্ধেকে। সেতু পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, দুই দফা ইজতেমার কারণে যান চলাচল কিছু বাড়লেও অবরোধের কারণে সেতুর গড় আয় কমেছে প্রতিদিন ৪০ লাখ টাকা করে। এ
কই অবস্থা দেশের অন্য সব সড়ক, মহাসড়ক ও সেতু পারাপারের ক্ষেত্রেও। যাত্রী, পরিবহনমালিক ও স্থানীয় প্রশাসনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবরোধের কারণে দেশের মহাসড়কগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। শুধু মহাসড়কই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত জেলা ও উপজেলার আঞ্চলিক সড়কগুলোর চলাচল বলতে গেলে প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যাত্রীবাহী বাস চলাচলে সহায়তা করলেও এর পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বাস না থাকায় বিপাকে পড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। ১২ জেলা থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে দেখা গেছে, ওই সব জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৭ হাজার ৯৬টি যাত্রীবাহী বাস চলত। এখন চলছে মাত্র ২ হাজার ৬৮৮টি। অর্থাৎ বর্তমানে যাত্রীবাহী বাস চলছে ৩৮ শতাংশ। তবে বিজিবি জানিয়েছে, গত ১২ ঘণ্টায় র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩২ হাজার ৪১৭টি যানবাহনকে পাহারা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। পরিবহনমালিকেরা বলছেন, দূরপাল্লার পথে চলাচলকারী নামীদামি পরিবহন কোম্পানিগুলো অবরোধে বাস বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিটি বাসের দাম ৭৫ লাখ থেকে পৌনে দুই কোটি টাকা। হরতাল-অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত বাস ইনস্যুরেন্স সুবিধা পায় না। এ কারণে তারা বাস চালাচ্ছে না। তা ছাড়া, বোমা হামলার ভয়ে ২০-২২ শতাংশের বেশি যাত্রী আসছে না। পরিবহন কোম্পানিগুলো হিসাব দিয়ে বলেছে, রাজধানীর তিনটি বাস টার্মিনাল থেকে দেশের ছয়টি বিভাগের বিভিন্ন জেলায় স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে। যাত্রী চলাচল করে প্রায় পৌনে দুই লাখ। এখন বাস চলছে গড়ে এক হাজার, আর যাত্রী ৩৫-৩৬ হাজারে নেমে এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মোটরসাইকেল ও মালবাহী যান বাদ দিলে সারা দেশে যাত্রীবাহী যানের নিবন্ধন আছে প্রায় আট লাখের। আর অনিবন্ধিত যাত্রীবাহী যানবাহন আছে আরও ছয় লাখ। এর বেশির ভাগই নছিমন-করিমন-ভটভটি। সব মিলিয়ে যাত্রী পরিবহনকারী যানবাহনের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৪ লাখ। এর অন্তত ২০ শতাংশ বসে থাকে, সব সময় চলে না। ফলে প্রতিদিন প্রকৃত অর্থে যানবাহন চলে ১১ লাখ। এসব যানের অনেকগুলো একাধিকবার চলে। গড়ে তিনবার করে ধরলেও দৈনিক ৩৩ লাখ বার চলে যাত্রীবাহী যানবাহন। আর এসব যাত্রায় যাত্রী পরিবহন হয় কয়েক কোটি। দেশের সবচেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করে ছয়টি মহাসড়ক দিয়ে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-মাওয়া। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) হিসাবে, এই ছয়টি মহাসড়ক ধরে প্রতিদিন বাস চলাচল করে গড়ে ৫০ হাজার। এসব যানবাহনের বেশির ভাগই বাস-মিনিবাস, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, কার, অটোরিকশা। কিছু নছিমন-করিমন-ভটভটি। সওজের হিসাবে, সবচেয়ে বেশি যানবাহন চলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে। এই পথে দৈনিক গড়ে যানবাহন চলে ১০ হাজার ৯১২। সবচেয়ে বেশি চলে বাস, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ও কার। বিজিবির সদস্যরা গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার গণপরিবহন চলাচলে সহায়তা করছেন। চট্টগ্রাম আন্তজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন আহমেদ জানান, চট্টগ্রাম থেকে আন্তজেলা সড়কপথে (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) ৬০০ বাস চলাচল করত। এখন গড়ে চলে ২৫০টির মতো। তবে চট্টগ্রামের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলা, তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ প্রায় স্বাভাবিক রয়েছে। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও বিলাসবহুল গাড়ির সংখ্যা একেবারেই কম। ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে যানবাহন চলাচল করে গড়ে ১০ হাজার ৪২৬টি। এই পথে বাস-ট্রাক, কারের পাশাপাশি স্থানীয় যানবাহনও চলে প্রচুর। প্রথম আলোর ময়মনসিংহ প্রতিনিধির পাঠানো হিসাবে দেখা গেছে, এই পথে প্রতিদিন গড়ে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার মিলে এখন চলছে ২৫০টি যাত্রীবাহী বাস। ঢাকা-আরিচা পথে দৈনিক যানবাহন চলাচল করে গড়ে ৮ হাজার ৮০০। গত সাত দিনে এই পথে বিজিবির পাহারায় এক হাজারের মতো যাত্রীবাহী বাস চলাচল করেছে। আর টাঙ্গাইল-হাটিকুমরুল হয়ে উত্তরবঙ্গের পথে যান চলাচল করে প্রায় ৮ হাজার ২০৭টি। গত সাত দিনে এই পথে দেড় হাজারের মতো যাত্রীবাহী বাস চলাচল করেছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে গড়ে দৈনিক যান চলাচল করে ৭ হাজার ৫৭৯। এর মধ্যে শুধু সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের আওতাধীন প্রতিদিন ১ হাজার ৯৫০ থেকে দুই হাজার বাস যাত্রী নিয়ে চলাচল করত। অবরোধের শুরুতে এ সংখ্যা কমে ৫০ থেকে ৮০-তে নেমে আসে। বর্তমানে বাস চলাচলে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়ায় এ সংখ্যা বেড়েছে। জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম আহমদ জানান, সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে গত তিন দিনে গড়ে ৫৫০ থেকে ৭০০টি বাস চলাচল করছে। তবে এগুলোর অধিকাংশ রাতে চলেছে। জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নভুক্ত বাস ছাড়াও দূরপাল্লার (গ্রিনলাইন, ভলভো, সোহাগের মতো পরিবহনগুলো) ২৪ থেকে ৩৪টি গাড়ি চলত অবরোধের আগে। এখন চলে ৬ থেকে ১৪টি। পরিবহন মালিক সমিতি সিলেট বিভাগীয় কমিটির মহাসচিব আবুল কালাম জানান, শুরুর দিকে নিরাপত্তাহীনতায় গাড়ি চলাচল করেনি। এক সপ্তাহ ধরে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি কিছুটা কমায় বাস চলাচল করছে। তবে আতঙ্ক থাকায় যাত্রী আসছে কম। আর ঢাকা-মাওয়া পথে যানবাহন চলাচল করে প্রতিদিন ৪ হাজার ৫৩টি। বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা-মাওয়া সড়কে প্রতিদিন গড়ে তারা ৫০০টি যানবাহনকে পাহারা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে। একই ধরনের পরিস্থিতি ফরিদপুর ও রাজশাহীতে। ফরিদপুরে স্বাভাবিক সময়ে জেলা শহর থেকে ৫২৫টি বাস চলাচল করে। এখন চলছে ৩৭৮টি। রাজশাহী থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আন্তজেলা ও স্থানীয় রুট মিলিয়ে ৫২০টি বাস চলাচল করে। এখন চলে ১১০টি। রংপুর থেকে ঢাকা ও আন্তজেলার আনুমানিক ৩৫০টি বাস চলাচল করে। অবরোধের কারণে বর্তমানে পুলিশ ও বিজিবি পাহারায় ২০-৩০টি বাস চলাচল করছে বলে জেলা মোটর মালিক সমিতি জানিয়েছে। পিরোজপুর বাস মালিক সমিতির অফিস সচিব জাহিদ হাসান জানিয়েছেন, স্বাভাবিক সময়ে দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ সড়কপথে ৩৩২টি বাস চলাচল করে। এখন করছে ২৩০টি। স্বাভাবিক সময়ে বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ সড়কপথে ২০০ গাড়ি চলাচল করত। একেকটি বাস গড়ে তিনবার যাওয়া-আসা (ট্রিপ) করে। সেই হিসাবে বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ সড়কপথে প্রায় ৬০০ যানবাহন চলাচল করে। এ ছাড়া ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বেনাপোলসহ দূরপাল্লার ৩৫০টি বাস চলাচল করত। বর্তমানে সব মিলিয়ে চলছে ১০০টি। বরিশাল জেলা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আফতাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অবরোধে নাশকতার ভয়ে যাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে। ফলে স্বাভাবিক সময় বরিশাল থেকে যত গাড়ি চলত, এখন তা তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। পুলিশি নিরাপত্তায় কিছু পরিবহন চলছে। যান চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন মালিক ও শ্রমিকেরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আজিজুল আলম জানান, হরতাল-অবরোধের আগে যশোর শহরের ওপর দিয়ে যাওয়া ১৮টি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রতিদিন ৬০০-৭০০টি যাত্রীবাহী বাস চলাচল করত। এখন সাড়ে তিন শ থেকে চার শ-তে নেমে এসেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দূরপাল্লার বাস চলত ১৭৭টি। এখন গড়ে ৯৮টি চলছে। মানিকগঞ্জ জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি কাজী এনায়েত হোসেন জানান, মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ৩০০ বাস চলাচল করে স্বাভাবিক সময়ে। আর অবরোধের সময় চলছে ২০০। কুমিল্লা থেকে বিভিন্ন সড়কপথে আগে ৪১২টি বাস চলত। এখন চলছে ৪৭টি। কুমিল্লা থেকে চাঁদপুরগামী বোগদাদ পরিবহনের মালিক আবদুল হক বলেন, গত বৃহস্পতিবার চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার জগৎপুর এলাকায় বোগদাদ পরিবহনের কুমিল্লা-ব-১১-১০৩ নম্বরের বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এখন আর বাস নামাতে সাহস পাচ্ছেন না তিনি। তিন টার্মিনাল থেকে কত বাস, কত যাত্রী: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন অন্তত আড়াই হাজার যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে। গড়ে ৩৫ জন যাত্রী ধরলে প্রতিদিন মানুষ যাতায়াত করে প্রায় ৮৭ হাজার ৫০০ জন। এই টার্মিনাল থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের অধিকাংশ জেলার বাস চলে। বর্তমানে এই পথে দৈনিক বাস চলে গড়ে ৪০০। সে হিসাবে যাত্রী যাতায়াত করে প্রায় ১৪ হাজার। গাবতলী টার্মিনাল থেকে উত্তর, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব জেলার বাসই চলে। স্বাভাবিক সময়ে এই পথে বাস-মিনিবাস চলে প্রায় ১ হাজার ৬০০। এর মধ্যে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে চলে প্রায় ৪০০। এসব বাস-মিনিবাসে গড়ে ৩৫ জন করে যাত্রী ধরলেও প্রতিদিন প্রায় ৫৬ হাজার মানুষ যাতায়াত করে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবরোধ-হরতালের কারণে এই টার্মিনাল থেকে উত্তরবঙ্গের পথে বাস চলাচল নেই বললেই চলে। দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণের জেলা ও ঢাকার আশপাশে বাস-মিনিবাস চলে ৫০০। সেই হিসাবে এখন প্রতিদিন যাতায়াত করছে সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর বিভাগ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রায় ১৬টি জেলায় বাস চলাচল করে। স্বাভাবিক সময় এই টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন গড়ে বাস চলে ৯০০। যাত্রী যাতায়াত করে গড়ে ৩১ হাজার ৫০০ জন। অবরোধ শুরু হওয়ার পর বাস চলাচল করছে গড়ে ২০০ এবং যাত্রী হয় সাত হাজার। এর মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ, ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া পথের বাসই বেশি। উত্তরবঙ্গের অনেক জেলায় মহাখালী থেকে কোনো বাসই চলে না। যানবাহন চলাচলের ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বোমা হামলাকারীদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সজাগ হতে হবে। সন্ত্রাস বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তথ্য পাওয়া মাত্র তারা সেটা পুলিশকে জানিয়ে দিলে বোমাবাজির ঘটনা কমে যাবে। প্রাণহানি কমে গেলে ভীতিও থাকবে না। এতে করে যানবাহন চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

No comments:

Post a Comment