চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও অবরোধে ব্যাংকের ঋণপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, এমনিতেই বিনিয়োগ স্থবিরতায় ব্যাংকগুলোর নাজুক অবস্থা, পাশাপাশি টানা অবরোধে ব্যাংকের চলমান বিনিয়োগও থেমে গেছে। শুধু ঋণপ্রবাহই কমছে না, ব্যাংকের নিয়মিত আদায়ও কমে গেছে। পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি না হলেও ব্যাংকের আয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। বেশির ভাগ ব্যাংকই লোকসানের সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযা
য়ী, ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে যে পরিমাণ আমানত গ্রহণ করে তার পুরোটাই বিনিয়োগ করতে পারে না। আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বাধ্যতামূলক দৈনিক ভিত্তিতে নগদ জমা সংরক্ষণ করতে হয় ৬ শতাংশ এবং ১৫ দিন অন্তে সাড়ে ৬ শতাংশ, যা ব্যাংকিং ভাষায় সিআরআর। আবার সিআরআর-এর পাশাপাশি ১৩ শতাংশ হারে (বাধ্যতামূলক) তরল সম্পদ ট্রেজারি বিল, বন্ড ইত্যাদির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়। এটা ব্যাংকিং ভাষায় এসএলআর। এতে ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে এর বিপরীতে সাড়ে ১৯ শতাংশ হারে এসএলআর ও সিআরআর সংরক্ষণ করে। বাকি সাড়ে ৮০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে ব্যাংক। এর বাইরে ব্যাংকগুলো রিজার্ভ ফান্ড থেকেও বিনিয়োগ করতে পারে। এতে দেখা যায়, বিনিয়োগ চাহিদা বেড়ে গেলে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৯০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ (গত ২৭ নভেম্বর ভিত্তিতে তৈরিকৃত) ঋণ আমানতের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতের ঋণ আমানতের অনুপাত নেমে এসেছে ৭০ দশমিক ৪৫ শতাংশে। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, এ ব্যাংক চারটির ঋণ আমনতের অনুপাত নেমে এসেছে ৫৪ শতাংশে। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭৭ শতাংশ থাকলেও বিদেশী ব্যাংকগুলোর নেমে গেছে ৭০ শতাংশে। ব্যাংকারদের মতে, এ চিত্র তো গত নভেম্বর প্রান্তিকের। গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে এ চিত্র আরো ভয়াবহ অবস্থানে নেমেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যাংকে ঋণচাহিদা নেই। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধা বাড়েনি। সেই সাথে গত বছর জানুয়ারিতে একতরফা নির্বাচনের পর থেকে বিনিয়োগ বলতে গেলে পুরোপুরিই স্থবির। ব্যবসায়ীদের আস্থার সঙ্কটে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর ফলে ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এক সময় তহবিল ব্যবস্থাপনাব্যয় কমাতে ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়। ফলে ব্যাংকের আমানত এখন চলে যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য খাতে। এতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে, যদিও কিছুটা চলমান বিনিয়োগ ছিল, গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে তাতে পুরোপুরি স্থবিরতা নেমে এসেছে। টানা অবরোধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণের পাশাপাশি ঋণ আদায়ও কমে গেছে। যারা এত দিন নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন, তারা চলমান হরতাল অবরোধের মধ্যে আর ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। অপর এক ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, বর্তমানে এ অচলাবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন চলতি বিনিয়োগকারীরা। যেমন, পরিবহন সেক্টরে বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে কয়েকটি ব্যাংকের। ব্যাংকঋণ নিয়ে অনেকেই পরিবহন ব্যবসায় চালাচ্ছেন। পরিবহন খাতে ঋণের বেশির ভাগই যথাসময়ে আদায় হচ্ছিল। কিন্তু গত প্রায় এক মাস হতে চললো, পরিবহন ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। অবরোধের কারণে গাড়ি চালাতে না পারায় আয় হচ্ছে না। এতে যারা এত দিন নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারা আর এক মাস অতিবাহিত হলে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হবেন। ব্যাংকারদের মতে, পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এখন সরকারের সাথে বিরোধীদের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হওয়া উচিত। অন্যথায় অর্থনীতির অন্যান্য উপখাতের মতো ব্যাংকিং সেক্টরও বড় ধরনের সঙ্কটের সম্মুখীন হবেÑ যা দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment