Friday, March 27, 2015

ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয়ের নানা আলামত:যুগান্তর

ব্যাংকিং খাতে টাকার প্রবাহ আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। গত জানুয়ারিতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর ব্যাংকিং খাতে টাকার প্রবাহের অনেকগুলো সূচকে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে বাজারে টাকার প্রবাহ, অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ, সরকারি ও বেসরকারি খাতের ঋণ, আমানত সংগ্রহ এবং রাজস্ব আহরণ কমেছে। ওই সময়ে বেড়েছে কেবল সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ।
ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=acd94d5f' target='_blank'> ব্যাংকিং খাতের জন্য এসব উপসর্গকে বিপর্যয়কর বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা এ বিপর্যয় এড়াতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের ব্যাংকিং খাতে এমনিতেই নেতিবাচক অবস্থা বিরাজ করছে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে তা বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে। আর ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ঘটলে পুরো অর্থনীতিই আক্রান্ত হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত গত দুই বছর ধরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় দেশে বিনিয়োগে মন্থরগতি বিরাজ করছে। বিনিয়োগ না হওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়ছে না। ঋণ না বাড়ায় একদিকে ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। অন্যদিকে মুখ থুবড়ে পড়েছে কর্মসংস্থান বাড়ার গতি। ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি এক ধরনের স্থবিরতার জালে আটকে রয়েছে। এর দ্বারা পর্যায়ক্রমে অর্থনীতির সবগুলো ক্ষেত্রই আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ ছিল ৭ লাখ ৪১ হাজার ২৪৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৫২৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ওই এক মাসের ব্যবধানে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে ২ হাজার ৭২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। টাকার প্রবাহ কমায় কমেছে ঋণের প্রবাহ। বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা থাকায় ব্যাংকে টাকা জমা রাখার পরিমাণও কমে গেছে। বেড়েছে হাতে টাকা রাখার পরিমাণ। টাকার প্রবাহ কমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে টাকার হাতবদলও। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শুধু রাজনৈতিক নয়, যে কোনো ধরনের অস্থিরতা বা অনিশ্চয়তা দীর্ঘ সময় থাকা উচিত নয়। এটি থাকলে কেউ ঝুঁকি নিতে চাইবে না। আর ঝুঁকি না নিলে অর্থনীতি এগোবে না। যারা বিনিয়োগ করেন তারা সব সময়ই এক ধরনের ঝুঁকিতে থাকেন। এর মধ্যে যদি রাজনৈতিক ঝুঁকি যুক্ত হয়, তাহলে তো ঝুঁকি আরও বেড়ে গেল। তখন তারা বিনিয়োগ করা থেকে পিছিয়ে যাবেন। গত দুই বছর ধরে অর্থনীতিতে এমনটিই হয়েছে। গত দুই মাসে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহের স্থিতি ছিল ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকায়। ওই সময়ে ঋণ প্রবাহ কমেছে ২ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ কমার কারণে সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই ঋণের প্রবাহ কমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমায় শিল্প খাতের বিকাশ কমে গেছে। ফলে কমেছে কর্মসংস্থান বাড়ার গতিও। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি ছিল ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার ৮৮২ কোটি টাকায়। একই সময়ের ব্যবধানে সরকারি খাতে ঋণের স্থিতি কমেছে ৮৭৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে সরকারি খাতে ঋণের নিট স্থিতি ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৯০ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ২১৪ কোটি টাকায়। সরকারের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ায় টাকার ছাড় কমে গেছে। যে কারণে কমেছে ঋণের পরিমাণও। যদিও ওই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। সরকারি খাতের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের স্থিতিও কমেছে ওই সময়ে। গত ডিসেম্বরে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণের স্থিতি ছিল ১৮ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায়। ওই সময়ে তাদের ঋণ কমেছে ৩৪২ কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও। ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে গেছে। গত ডিসেম্বরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকায়। ওই এক মাসের ব্যবধানে রাজস্ব আদায় কমেছে ৫৫৩ কোটি টাকা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার বিষয়ে অর্থনীতি ইতিমধ্যেই নানাভাবে সতর্ক বার্তা দিতে শুরু করেছে। বিভিন্ন সূচকের পতনই এ বার্তা। এটি অনুধাবন করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে বড় মাশুল দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মানুষ হাতে বেশি টাকা রাখছে। এছাড়া বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তারাও এখন আমানত নেয়া কমিয়ে দিয়েছে। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। জানুয়ারিতে ৬ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে আমানত কমেছে ৩ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, এক মাসের তথ্য দিয়ে অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। এখন যেটি খারাপ, আগামীতে সেটি আবার ভালো হয়ে যেতে পারে। প্রতি মাসেই অর্থনীতির সূচকগুলোতে পরিবর্তন আসছে। উল্লেখ্য, ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দেশে টানা অপরোধ কর্মসূচি পালন করছে। এর সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো বাদ দিয়ে বাকি সময়ে প্রায় নিয়মিতভাবেই ছিল হরতাল কর্মসূচিও। সাম্প্রতিক সময়ে আন্দোলন কর্মসূচির তেমন কার্যকারিতা দেখা না গেলেও মূল রাজনৈতিক সংকটের কোনো সমাধান মেলেনি। এ পরিস্থিতি অর্থনীতির অস্বস্তিকেই বাড়িয়ে চলেছে।  

No comments:

Post a Comment