Friday, March 27, 2015

ভারতকে মাটিতে নামিয়ে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া:কালের কন্ঠ

অস্ট্রেলিয়া : ৫০ ওভারে ৩২৮/৭ ভারত : ৪৬.৫ ওভারে ২৩৩ ফল : অস্ট্রেলিয়া ৯৫ রানে জয়ী যতটা ভাবা হয়েছিল, সিডনি তার চেয়ে বেশি ভারত-ভারত সাজ নিল। যতটা ভাবা হয়েছিল, উইকেট ঠিক ততটাই ভারত-ভারত ভাবের হলো। একটা জিনিসই যতটা ভাবা হয়েছিল, ততটা উচ্চতায় গেল না। ভারতের ক্রিকেট। এমনই অবস্থা যে প্রথম ইনিংস শেষ হতেই দেখলাম, সম্ভাবনা নেই বুঝে সৌরভ গাঙ্গুলী বারবার প্রেসবক্সে এসে আড্ডায় মত্ত হয়েছেন। ভারতের ইনিংসের শুরুর দ
িকে ব্র্যাডম্যান লাউঞ্জের কোনায় কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন মাইকেল হোল্ডিং।  মাঠের পেছন দিকে ফিরে বলে সেখানকার ঘটনা দেখতে পাচ্ছিলেন না, হইচই শুনে সেদিকে ফিরলেন। একটা ছক্কা হয়েছে, পাত্তা না দিয়ে বললেন, 'ও রকম আরো ১০০টা দরকার।' ১০০টা হয়তো লাগত না, কিন্তু যতটা লাগত তার চেয়ে ভারত এত দূরে থাকল যে অস্ট্রেলিয়া-ভারত নিয়ে মাঠের বাইরে যে গর্জন, তার সঙ্গে মাঠের বর্ষণ একটুও মিলল না। একপেশে ম্যাচ, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মর্যাদার সঙ্গে মানায় না। যেমন মানায় না সাম্প্রতিক সময়ের ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের রণসংগীতের সঙ্গেও। বড় ম্যাচ হলে বাংলাদেশে যা হয়, মাইল দূরে মানুষকে নামিয়ে দেওয়া হয়, রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা যুদ্ধংদেহি ভাব নিয়ে থাকে, এখানে তেমন ব্যাপারই নেই। সব স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যেও কাল বেশ দূরে নামতে হলো গাড়ি ছেড়ে। কারণ! ভারতীয় সমর্থকরা যে চত্বরটা দখল করে নিয়েছে। এক দোতলা বাসে দেখলাম একদম 'বল্লে বল্লে' জাতীয় নাচ নাচছে। এর মধ্যে কোথায় অস্ট্রেলিয়া? অনেক চেষ্টা করে শেষে হলুদ জার্সি গায়ে একজনকে দেখলাম, যে এমন মাথা নিচু করে হাঁটছে, যেন ভুল জায়গায় এসে পড়ায় লজ্জিত। নিজের দেশে, নিজের মাঠে মানুষকে কখনো এমন অতিথি হয়ে যেতে হয়! মাঠেও অস্ট্রেলিয়ানরা যেমন অতিথি। অস্ট্রেলিয়ার উইকেট পতনে পুরো গ্যালারির উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে তাহলে দেশ, দেশের সীমানা- এসব ব্যাপারস্যাপার নিয়ে বোধ হয় নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। এখনকার খোলা হাওয়ার পৃথিবীতে ব্যাপারটা মানতে হবে। কিন্তু ক্লার্কদেরও নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। সেই খারাপ লাগাটা তাড়না হয়ে তাতিয়ে তোলে। অস্ট্রেলিয়া থাকে অস্ট্রেলিয়ার চেহারায়। প্রমাণ হয়, আবেগ, চোখের জল, অর্থ- এগুলো বড় বটে, তবে আজও অত বড় নয় যে ঢোল-তালি দিয়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে জেতা যায়। বরং পটভূমিতে যে পর্দাই থাকুক, আবহ সংগীতে যে সুরই বাজুক, শেষ পর্যন্ত ব্যাট-বলের খেলা খেলেই জিততে হয়। সেই খেলায় অস্ট্রেলিয়া ভারতের চেয়ে বড় শক্তি আজও। কোনো দিন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারেনি অস্ট্রেলিয়া, ধারাটা তাই ধারালো ক্রিকেটে বজায় থাকে। যেমন অক্ষুণ্ন থাকে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দ্বৈরথের আরেকটি ধারাও। অস্ট্রেলিয়ায় চার মাস আগে আসা ভারত অস্ট্রেলিয়াকে একটা ম্যাচও হারাতে পারেনি। তারপর বিশ্বকাপে অন্য কারো কাছে একটা ম্যাচও হারেনি। আবার যখন সামনে অস্ট্রেলিয়া, তখন ভারতের মাঝখানের 'মাস্তানি' শেষ। মহীরুহ থেকে আবার ওরা ময়দানের সাদামাটা দল। শেষ উইকেটটা নিতে পারলে ফকনারের হ্যাটট্রিক হয়, ঠিক সেই সময়ের ছবি। পাঁচজন দাঁড়িয়ে স্লিপে। সঙ্গে গালি-পয়েন্ট মিলিয়ে পুরো ত্রিশগজী বৃত্তেই সব ফিল্ডার। শেষ উইকেট যখন, যখন হ্যাটট্রিক সুবাস নিয়ে দাঁড়িয়ে, তখন এমন ফিল্ডিং স্বাভাবিক। তবু যেন শেষভাগে ছবিটা তৈরি হলো এই সত্যটা বোঝাতে যে বোলিং, বিশেষ করে পেস বোলিং আজও জীবিত। লাগাম পরিয়ে যতই তাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা চলুক, সে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকে। সময়মতো জেগে-জ্বলে আগুন লাগিয়ে দেয়। কালকের অস্ট্রেলিয়ার জয় তো আসলে পেস বোলিংয়ের জয়ও। উইকেট স্লো বোলারদের সাহায্য করবে, বল সেভাবে টার্ন না করলেও গতির মন্থরতার কারণে স্পিনাররা গুরুত্বপূর্ণ থাকবেন। সেই হিসাব অস্ট্রেলিয়া জানত, অশ্বিন দুর্দান্ত বোলিং করে সেটা প্রমাণও করলেন, তবু তারা তাদের পেস নীতিতে অটল রইল। আর সেই পেসাররা প্রায় বিরোধী পক্ষ হয়ে থাকা উইকেটেও গতির বন্যতা আর লেন্থের নিখুঁততায় ঠিকই বাজিয়ে গেলেন তাদের জয়গান। জানা গেল, বলি দেওয়ার অপচেষ্টাটা পুরো সফল হবে না কোনো দিনই। ক্রিকেট তার পৌরুষের-শক্তির এই সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিতও হবে না। খুব যে ধ্বংস করে দিয়েছেন এমন নয়, গোলার শক্তিতে বল ছুড়েছেন এমনও নয়, তবু সবাই মিলে শক্তিটাকে এমন অর্কেস্ট্রোর মতো বাজিয়েছেন যে ইনিংস শেষে দেখছি সবার উইকেট আছে। ফকনারের তিনটি, জনসন-স্টার্কের দুটি করে, হ্যাজলউডের একটি। কিন্তু কে উইকেট কমবেশি পেলেন সেটা খুব বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার হলো শুরু থেকেই চাপটা বজায় রাখা। আর তাতে এখন আর তখন, যখনই হোক উইকেট হারাতে বাধ্য ছিল ভারত। একে অত বড় রানের বোঝা, তার ওপর টানা গতিতে জায়গায় বল রাখা, ঝোড়ো গতির বলে চমকে দেওয়া। ১৩ ওভারে ৭৬ রানের উদ্বোধনী জুটি যদিও স্কোর কার্ডে চমৎকার দেখায়, কিন্তু দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানই ক্যাচ দিয়ে এবং বেঁচে জেনে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান বোলিংয়ের মেজাজটা। এরপর বিরাট কোহলি যখন জনসনের বাউন্সারটা ঠিক পড়তে না পেরে ক্যাচ দিলেন, তখনই আসলে শেষটা লেখা হয়েছিল। যদিও এরপর ধোনি-রাহানের একটা জুটি হয়েছে, কিন্তু ৩২৮ রানের ম্যাচে এসব জুটি আসলে প্রতিপক্ষের অপেক্ষা বাড়ানোর বেশি কিছু করতে পারে না। টিভিতে একসময় একটা বিজ্ঞাপন দেখাত। একই বলে লেগব্রেক-অফব্রেক দুটিই হচ্ছে। টিভির বানানো বিজ্ঞাপন, বাস্তবের অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু অধুনা একজনের ব্যাটিং দেখতে দেখতে মনে হয়, একই বলে দুই রকম নয়, কয়েক রকমের শট খেলা সম্ভব। অত সময় পান শট খেলার মনে হয় যে পেস বলেও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে, সিদ্ধান্তটা বদলে, স্টান্সটাও পরিবর্তন করে খেলা সম্ভব। ব্যাটটা যেন তৃতীয় হাত, যেভাবে চাইছেন সেভাবেই মারতে পারছেন। নামটা! স্টিভ স্মিথ। এলেন যখন, তখনো এমন কিছু ভিত্তি তৈরি হয়নি, বরং ওয়ার্নারের ফিরে যাওয়াতে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে। ওদিকে ফিঞ্চ ব্যাটিং করাটা যে খুব কঠিন সেটা প্রমাণ করে চলছেন। তিনি মনে হলো এসব দেখেও দেখলেন না। অথবা হয়তো দেখলেন, কিন্তু বুঝতে দিলেন না। এত অনায়াস ভঙ্গি, এমন সাবলীল ব্যাটের বিচরণ যে তাঁর একার হাতেই ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়ার পকেটে চলে গেল। ৯৩ বলে ১০৫ রান, আজকালকার যুগে এমন ভয়ংকর কোনো স্কোরের ছবি নয়, কিন্তু স্মিথের ব্যাটিং আসলে অঙ্ক দিয়ে বোঝানো যায় না। এ বোঝার জন্য মন, দেখার জন্য চোখ থাকতে হয়। টি-টোয়েন্টির সূত্রে শট উদ্ভাবনের একটা জোয়ার চলছে, ডি ভিলিয়ার্স সেই পথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্মিথ সেই পথের পথিক নন, বরং ভাঙচুরের এই যুগে শুদ্ধ ব্যাটিংটাকেই অন্য ঢংয়ে সাজিয়ে জানাচ্ছেন, চিরন্তন ধারা মেনেও নতুনত্ব তৈরি করা যায়। তাঁর ব্যাটে তাই ধ্বংস হয়, কিন্তু সেটা দেখা যায় না। মার হয়, কিন্তু যেন শব্দ হয় না। এই ইনিংসটি সম্ভাবনা তৈরি করেছিল রান সাড়ে তিন শ ছাড়িয়ে দেওয়ার, কিন্তু ভারত ম্যাচে এই একবারই বলার মতো ঘটনা ঘটায়। স্মিথ-ফিঞ্চের ১৮২ রানের জুটি ভাঙার পর ৫১ রানের মধ্যে ৪ উইকেট নিয়ে তিন শর মধ্যেই ইনিংস শেষ করে দেওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। ম্যাক্সওয়েলের ঝড় যখন জমে না, ক্লার্ক যখন ফর্মে ফিরতে পারেন না, ওয়াটসন যখন আগুন হতে পারেন না, সেদিন আবার জনসনের মনে হয় তাঁরও কিছু ব্যাটিং জানা আছে। সত্যি বললে, বিন্দুও যেমন মাঝেমধ্যে সিন্ধুর ভূমিকা নেয়, ৯ বলে ২৮ রানের ইনিংসটাও সে রকমই যেন। রান তাই ৩২৮। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ৩০০ পেরোনো স্কোরই এই প্রথম, কাজেই এই রান টপকাতে কাউকে কাউকে স্মিথ হতে হয়। কিন্তু ভারতের স্মিথ নেই। কোহলি আছেন! সেই কোহলি বিশ্বকাপে এসে যতটা আনুশকার প্রেমিক, ততটা চ্যাম্পিয়ন ব্যাটসম্যান নন। তাই যা হওয়ার তা-ই! ম্যাচটার গর্জনের সঙ্গে তাই বর্ষণ মেলে না। অস্ট্রেলিয়া-ভারত ম্যাচ আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদার লড়াই বলে সম্ভাবনার যে মই তৈরি হচ্ছিল, তাতে কোনো ধাপ আর যোগ হয় না। স্লেজিংয়ের কলঙ্ক, উত্তেজনার অলংকার- কিছুই নেই। আগের দিন বলেছিলাম এক টিকিটে তিন ছবির ম্যাচ। কিন্তু আসলে শেষ পর্যন্ত একটা ছবিই, শুধুই সেমিফাইনাল লড়াইয়ের অঙ্ক এবং সেটাও এমন ফ্লপ যে প্রথম সেমিফাইনাল বিশ্বকাপকে যেমন জমিয়ে দিয়েছিল, এটা তেমনি ঝিমিয়ে দিয়ে গেল। তবু জমে যাওয়ার ব্যাপার আছে একটা। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড। এমন কোনো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, তবু ছোট প্রতিবেশী-বড় প্রতিবেশীর দ্বন্দ্ব তো আছেই। আছে কিউইদের অস্ট্রেলিয়ানদের মাধ্যমে নিজেদের নিপীড়িত হওয়ার বঞ্চনাবোধ। আর এই প্রথম বিশ্বকাপে দুই স্বাগতিকের ফাইনাল। ও হ্যাঁ, এই ম্যাচ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিশ্বরাজত্ব হারাল! কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ক্রিকেট এবং ওরা দুই পক্ষই বাঁচল বোধ হয়। যে হাওয়া তৈরি হয়েছিল, তাতে ওরা জিতলে মনে হতো ওদের জেতানোর জন্যই এত কিছু। তারা হেরে গিয়ে বরং প্রমাণ করল, কিছু ব্যাপার হেলে থাকলেও তাদের জেতানোর জন্য বাড়তি কোনো আয়োজন আসলে ছিল না। যখন তারা জেতে, ক্রিকেটের শক্তিতেই জেতে। হারেও ক্রিকেটেই। বিশ্বকাপের আয়োজন শুধু তাদের জেতানোর জন্য নয়। খুব সম্ভব কালকের ম্যাচটা ভারত আর বিশ্বকাপের জন্য 'কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল'র মতো ঘটনাই!

No comments:

Post a Comment