Tuesday, September 23, 2014

মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত:কালের কন্ঠ

মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর থেকে কমিয়ে ১৬ বছর করা হলে তা দেশে প্রচলিত অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। একই সঙ্গে তা আন্তর্জাতিক শিশুবিষয়ক নানা নীতিমালার সঙ্গেও অসংগতি তৈরি করবে। কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিকাশেও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৪’-তে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর চিন্তাভাবনা প্রসঙ্গে দেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এমন মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, বিয়ের বয়স ক
মালে দেশে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাবে। ফলে আইনটি নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে। নারী উন্নয়নে এগিয়ে এসে আবার পিছিয়ে যাওয়ার উদাহরণ তৈরি হবে। এমনকি সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনেও এটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৪’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন হয়। তবে ওই সভা থেকে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর থেকে কমিয়ে ১৬ বছরে আনার কোনো রাস্তা আছে কি না তা খুঁজে বের করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সনদ, দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য পরামর্শ দেয় মন্ত্রিসভা। বিয়ের বয়স কমাতে মন্ত্রিসভার এমন চিন্তাভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৬ বছর করা হলে তা প্রচলিত আইনের সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক হবে। বয়স কমাতে চাইলে শিশু আইনে পরিবর্তন আনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যখন ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু বলছি, তখন তাদের বিয়ে দিই কী করে?’ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের গত মেয়াদে ‘শিশু আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অনূর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বৎসর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হইবে।’ ফলে শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত কারো বিয়ে হলে তা ‘শিশুবিয়ে’ই হয়ে যায়। জাতীয় শিশুনীতি-২০১১-তে শিশুর সংজ্ঞায় ধারা ২.১-এ বলা হয়েছে, ‘শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশের সব ব্যক্তিকে বোঝাবে। দেশের প্রচলিত কোনো আইনে এর ভিন্নতা থাকলে এই নীতির আলোকে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’ বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৬ করা হলে গত সরকারের আমলে তৈরি এ শিশুনীতির সঙ্গেও অসংগতি তৈরি হবে। বিয়ের বয়স কমালে তা শুধু দেশীয় আইন নয়, আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও সনদের সঙ্গেও অসামঞ্জস্য তৈরি করবে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোনো মানুষকে বোঝাবে।’ জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ সনদ গৃহীত হয়। বিশ্বের প্রথম যে ২২টি দেশ সনদটি অনুমোদন করে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। ১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে এ সনদ বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জন্য আবশ্যকীয় হয়েছে। বেশ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি কালের কণ্ঠকে জানান, দীর্ঘদিনের গবেষণা ও অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ১৮ বছরের কম বয়সে একটি ছেলে বা মেয়ে কখনোই পরিবারের গুরুদায়িত্ব নেওয়ার মতো পরিপক্বতা লাভ করে না। কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য বাল্যবিবাহ একটি হুমকি। বাল্যবিবাহ নারী নির্যাতনকে উসকে দেয়। এ ছাড়া মেয়েদের বিয়ের বয়স কমালে তা কিশোরী মায়ের সংখ্যা বাড়াবে। এর সুদূরপ্রসারী খারাপ প্রভাব পড়বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে। ফলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য, নারীশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছে তা খর্ব হবে। ১৮ বছরের আগে মেয়েরা সন্তান জন্মদানের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত হয় না বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি অনকোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘যেসব মেয়ে ১৮ বছরের আগে সন্তান ধারণ করে তাদের নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে এসব মেয়ের খিঁচুনি ও রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। কিশোরী মায়েদের প্রসবের সময় আরেকটি জটিল সমস্যা হলো বাধাপ্রাপ্ত প্রসব বেদনা। এর কারণ হলো, নারীদের প্রসব রাস্তার পাশে যে ‘পেলভিস বোনস’ থাকে তা ১৮ বছরের আগে পূর্ণতা লাভ করে না। ফলে বাচ্চা প্রসবের জন্য যথেষ্ট জায়গা থাকে না। এ জন্য প্রসব বাধাগ্রস্ত হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘শুধু প্রসবকালীন নয়, প্রসবের পরও নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। কিশোরী মায়েরা বাচ্চার দেখাভাল ঠিকমতো করতে পারে না। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা যায়। অনেক বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ পায় না।’ একই ধরনের মত প্রকাশ করেন জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ল্যাপরস্কপিক সার্জন অধ্যাপক ডা. সরদার এ নাঈম। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি অঙ্গের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। ১৬ বছরের মেয়েদের অনেক অঙ্গই পরিপূর্ণতা পায় না। হরমোনের বিবেচনায় ১৬ বছরে নারী মা হতে পারে সত্যি, কিন্তু পরিপূর্ণ শারীরিক সক্ষমতা থাকে না। অনেক কিশোরী মানসিকভাবে যৌন সম্পর্কের জন্য তৈরি থাকে না। এ ক্ষেত্রে তাদের ওপর বলপ্রয়োগ হলে বাকি জীবনে যৌনতা নিয়ে তারা একটি নেতিবাচক ধারণা বয়ে বেড়ায়।’ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিয়ের বয়স কমানো হলে তা হবে সর্বজনীন চিন্তার উল্টো দিকে যাত্রা। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ যখন ১৮ বছর পর্যন্ত সবাইকে শিশু বলছে, তখন আমরা পেছনের দিকে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছি।’ তিনি বলেন, ‘বাল্যবিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ। ১৮ বছর পর্যন্ত বিয়ে নয়- এমন আইন থাকার পরও বাল্যবিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না। এর ওপর যদি আইনে আবার বয়স কমিয়ে দেওয়া হয়, তবে তো বাল্যবিবাহ আরো বেড়ে যাবে। ফলে যে উদ্দেশ্যে আইন করা তা ব্যর্থ হবে।’ শিশু আইন বিশেষজ্ঞ ড. নাহিদ ফেরদৌসী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু- এই মাপকাঠি গ্রহণ করা হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেশের শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সুবিধা হবে।’ ৪৭ সংগঠনের বিবৃতি : বিয়ের বয়স কমাতে মন্ত্রিসভার চিন্তাভাবনা প্রকাশের পর থেকেই এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে বিভিন্ন নারী ও মানবাধিকার সংগঠন। গত রবিবার বেসরকারি ৪৭টি নারী ও মানবাধিকার সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ‘সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভস অন সিডও, বাংলাদেশ’-এর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আর পেছনের দিকে হাঁটতে চাই না, সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। নারীর অগ্রযাত্রায় যে সাফল্যগুলো অর্জন করেছি, সেগুলো ধরে রাখতে চাই। সরকারের উচিত বিয়ের বয়স কমানোর মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকা।’ এর আগে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণের জন্য যে আলোচনা চলছে, তা এ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনোক্রমেই সংগতিপূর্ণ নয়। এ ধরনের বিধান বাস্তবায়িত হলে সমাজজীবনে এর বিরূপ প্রভাব অবশ্যম্ভাবী।’ শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের প্রজনন স্বাস্থ্যের যে অবস্থা তাতে করে নারীদের বিয়ের বয়স কমানোর কোনো সুযোগ নেই। প্রস্তাবটি বিপজ্জনক ও অপরিণামদর্শী।’

No comments:

Post a Comment