নূপুর আর পলাশ (আসল নাম নয়) একই জেলার বাসিন্দা। নূপুরের বয়স ১৩। পলাশের ১৬। নূপুর অষ্টম শ্রেণীর পাঠ শেষ করে নবম শ্রেণীতে উঠেছে। পলাশ কাঠমিস্ত্রির সাথে হেল্পার হিসেবে কাজ করে। পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি তার। মোবাইলের সূত্র ধরে এক দিন পরিচয় হয় নূপুর আর পলাশের। পরিচয় থেকে প্রেম। নূপুরের পরিবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই পলাশের হাত ধরে এক দিন বাড়ি ছাড়ে সে। নূপুর মেধাবী ছাত্রী। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছে। সচ্ছ
ল পরিবার। নূপুর স্কুল আর পড়াশোনার মাঝে ঘরের কাজে অসুস্থ মাকে সহায়তা করত মাঝে মধ্যে। এর মধ্যে কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারছেন না নূপুরের মা-বাবা কেউ। মাত্র অষ্টম শ্রেণী পাস ১৩ বছরের মেধাবী নূপুরের এভাবে বাড়ি থেকে পলায়নের ঘটনায় যেমন বিস্ময়ে হতবাক নূপুরের পরিবার তেমনি তাদের পাড়া-প্রতিবেশী। নূপুর বৃত্তি পাওয়ার পর খুশিতে তার বাবা তাকে একটি মোবাইল কিনে দিয়েছিলেন, সেটাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন তারা। নূপুরের মা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানান, নূপুর ভালো নেই। নূপুর বাড়ি ছাড়ার পর এবার নিয়ে তিনটা কোরবানির ঈদ পার হয়েছে। এর মধ্যে তারা কেউ কোনো দিন নূপুরের সাথে যোগাযোগ করেনি। তবে এলাকার লোকজনের কাছে নূপুরের খোঁজখবর তারা মাঝে মধ্যে পায়। নূপুরকে বিয়ে করে পলাশ নিজের বাড়িতে উঠিয়েছে। তাদের পারিবারিক ও আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। পলাশের বাবা দিনমজুর। পলাশও তাই। ছোট্ট একটি ছাপড়াঘরে তারা থাকে। নূপুরের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরসংসার নিয়েই কাটছে তার দিন। তিন বছর পার হয়ে গেলেও কেন মেয়ের সাথে কোনো যোগাযোগ করেননি জানতে চাইলে নূপুরের মা জানান, নূপুরকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। পড়াশোনা করে সে একদিন বড় কিছু হবে। আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু সে আমাদের কথা ভাবেনি, আমাদের মুখে চুনকালি দিয়ে চলে গেছে। আমরা সমাজে আর মুখ দেখাতে পারি না লজ্জায়। তার এভাবে চলে যাওয়াটা আমরা কেউ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারিনি। প্রথমে অনেকে অনেক ধরনের পরামর্শ দিয়েছিল। মামলার করার পরামর্শও দিয়েছিল। কিন্তু আমরা সে দিকে যাইনি। কারণ মেয়ে বেঁকে বসলে তাতে হয়রানি ছাড়া কোনো ফল হবে না। তাই আমরা বুকের কষ্ট বুকে চেপে চুপ করে বসে আছি। ভাগ্য বলে সব মেনে নিয়েছি। আমরা শোকে পাথর হয়ে গেছি। নূপুরের মা আফসোস করে জানান, যে ছেলেটার সাথে গেছে সে যদি ভালো হতো তবু মনে একটু শান্তি পাওয়া যেত। কিন্তু ছেলেটা অত্যন্ত খারাপ স্বভাবের। আমরা তাদের কোনো খোঁজ খবর না নেয়ায় এক দিন ছেলেটা (পলাশ) আমাকে ফোন দেয়। আমি তো আর তাকে চিনি না। আমি সালাম দিয়ে বললাম বাবা তুমি কে। সে আমাকে বলল ‘আমি তোর বাপ। আমাকে চিনিস না?’ ওই দিনই রাত ২টার দিকে সে আবার ফোন দেয় নূপুরের বাবার কাছে। নূপুরের বাবাও তার পরিচয় জানতে চাইলে সে তাকে বলে, ‘আমি তোর বাপ। তোর মেয়ে নূপুর যা ভাগে পায় তা আলাদা করে রাখিস। আমি শিগগিরই আসতেছি।’ তিনি জানান, নূপুরের বাবাও তাকে রাগের মাথায় কড়া জবাব দিয়েছে। সে তাকে বলেছে, আসিস। তোর মা-বাবার দোয়া নিয়ে আসিস। কারণ ফিরে যেতে পারবি কি না সন্দেহ। নূপুরের মা বলেন, এ ধরনের একটা ছেলের সাথে তার মেয়ে পালিয়ে গেছে। এ দুঃখ কোথায় রাখি। এরকম কোনো ছেলের কাছে কি মেয়ে ভালো থাকতে পারে? ভালো হলে না হয় মেনে নিতাম। কিন্তু এরকম ছেলেকে কী করে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নেয়া যায় আপনিই বলেন। নূপুরের মা বলেন, নূপুরের ছোট আরো দুই ভাই-বোন আছে। কিভাবে যে ছেলেমেয়ে মানুষ করব বুঝতে পারছি না। সমাজ খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের আর কতক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখা যায়। কলেজছাত্রী বাড়ি ছাড়ল অটোচালকের হাত ধরে আরেক ঘটনা। আব্বাস হাউমাউ করে কাঁদছেন। গত কোরবানি ঈদে তিনি গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে। সেই সুযোগে তার মেয়ে মিলি (আসল নাম নয়) গ্রামের একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। মিলি আব্বাসের বড় মেয়ে। ইন্টার পাস করেছে এ বছর। অনার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যে ছেলের সাথে সে বাড়ি ছেড়েছে সে তাদেরই এলাকার একজন অটোরিকশাচালক। মেয়ের এভাবে চলে যাওয়ার পর লজ্জায়-অপমানে আব্বাস আর ঘর থেকে বাইরে বের হননি সে দিন। এলাকার কারো সাথে যেন দেখা না হয় সে জন্য তিনি পরদিন রাতে পরিবার নিয়ে ঢাকা চলে আসেন। ঢাকা এসে তিনি প্রতিবেশীদের বলেছেন, মেয়ে তার মামার বাড়ি বেড়াতে গেছে। কিন্তু কত দিন আর এভাবে ঢেকে রাখা যায়? তাই আগের বাসা ছেড়ে নতুন আরেক বাসায় উঠলেন তিনি। গ্রামের লোকজন, শহরের প্রতিবেশী সবার থেকে আব্বাস নিজেকে কিছুটা আড়াল করতে পারলেও নিজের মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছেন না মেয়ের অপমানজনক ঘটনা। গ্রামের লোকজন এ নিয়ে কী আলোচনা করছে এ কথা ভাবতেই লজ্জায় ভেঙে পড়েন তিনি। বেশ সুখের সংসার ছিল আব্বাসের। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি ঢাকায় ব্যবসা করছেন। গ্রামে জমিজমা আছে। ঢাকায়ও জমি কিনেছেন। সেখানে বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা ছিল তার। আব্বাসের শুধু দুই মেয়ে। ইচ্ছা ছিল বড় মেয়েকে এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন যাকে তিনি নিজের ছেলে বলে মেনে নিতে পারবেন। মেয়ের জামাইকে দিয়ে ছেলে না থাকার স্বপ্ন পূরণ করবেন। ব্যবসাবাণিজ্য তার হাতে তুলে দিয়ে তিনি গ্রামে গিয়ে বসবাস করবেন। সহায়-সম্পত্তি যা আছে তা সবই তো মেয়েরাই পাবে। এরকম আরো কত স্বপ্ন ছিল মেয়েদের নিয়ে আব্বাসের। কিন্তু জীবনের আজ সব কিছুই কেমন অর্থহীন আর বিষাক্ত মনে হয় আব্বাসের কাছে। ব্যবসাবাণিজ্যেও আর আগের মতো মন নেই তার। কী হবে এসব করে। তবু লোকজনের সাথে লেনদেন রক্ষার্থে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তিনি বসেন। কেন, কিভাবে এরকমটা হয়ে গেল তার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করেন। তিনি সারা দিন ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসায় নিয়ে। পরিবার-সন্তানদের প্রতি খুব বেশি সময় দিতে পারতেন না। বড় মেয়ে ছিল তার কাছে অতি আদরের। যখন যা সে চেয়েছে তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মেয়ের কোনো কষ্ট, অভাববোধ তিনি মেনে নিতে পারতেন না। মেয়ে সারাক্ষই কানে মোবাইল লাগিয়ে রাখে স্ত্রীর কাছ থেকে এমন অভিযোগ তিনি অনেকবার শুনেছেন। কিন্তু তেমন গুরুত্ব দেননি। এটাই হয়ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। মিলির মা এ প্রতিবেদককে জানান, এসএসসি পাস করার পর মেয়েকে একটা মোবাইল কিনে দেয়া হয়। মেয়ে একা কলেজে যায়। কোথায় কোনো বিপদ আপদ হয় সে জন্য ভাবলাম সাথে একটা মোবাইল থাকলে খোঁজখবর রাখা যাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে মিলি মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়ে। মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্ত তার চলে না। পরে লক্ষ্য করলাম সে একা একা থাকতে পছন্দ করে। দিনরাত কানে মোবাইল আর দুই হাতে বাটন টেপাটেপি। এ নিয়ে মিলির বাবার কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। পরে এটাকে একটা সমস্যা মনে করে আমরা তার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু তখন মেয়ে বেঁকে বসল। সে জানালো এর চেয়ে তাকে যেন মেরে ফেলা হয়। তখন আমরা বুঝলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন জোর করে কিছু করলে হয়ত হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। চার দিকে অল্পবয়সী মেয়েদের আত্মহত্যার খবর বের হচ্ছে তুচ্ছ সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তাই আমরা ভয়ে তাকে বেশি চাপ দেইনি। কিছু দিন পর আমরা জানতে পারলাম সে গ্রামের একটা ছেলের সাথে মোবাইলে কথা বলে। এক বছর আগে ঈদে বাড়ি গিয়ে ওই ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। আমরা তাকে বুঝিয়েছি এ থেকে সরে আসার জন্য। সেও বলেছে তেমন কিছু না। আমাদের মতের বাইরে গিয়ে সে কিছু করবে না। কিন্তু আসলে সে আমাদের কাছে সত্য গোপন করেছে আমরা তা বুঝতে পারিনি। মিলির মা আফসোস করে জানান, মেয়ের এ ঘটনায় আমাদের জীবনের সব কিছু এখন অর্থহীন হয়ে গেছে। মিলির মায়ের মতো আরো অনেকের জীবন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণে।
No comments:
Post a Comment