Saturday, January 31, 2015

কক্সবাজারে কড়াকড়ি, ‘নিরাপদ’ চট্টগ্রাম:প্রথম অালো

কক্সবাজার উপকূলে নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় মানব পাচারের জন্য এখন চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমা ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিতেই মূলত পাচারকারীরা তাদের গতিপথ ও কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও পাচারের চেষ্টাকালে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের (চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত) দায়িত্বপ
্রাপ্ত ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম জানান, কক্সবাজার উপকূলে নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম উপকূল বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর আশপাশ এলাকা দিয়ে মানব পাচারের চেষ্টা করছে পাচারকারীরা। কর্ণফুলী নদী দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মাছ ধরার ট্রলার আসা-যাওয়া করে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে করে মানব পাচারের চেষ্টা করছে তারা। এ কারণে এখন মাছ ধরার ট্রলারেও তল্লাশি চালানো হবে। ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম বলেন, মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ১৮০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা তদারকির জন্য কোস্টগার্ডের সরঞ্জাম ও জনবলসংকট রয়েছে। তবে পাচারকারী ধরতে কোস্টগার্ডের আন্তরিকতার অভাব নেই। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে ১ হাজার ২২ জনকে আটক করা হয়েছে। গত দুই মাসে পাচারের চেষ্টাকালে উদ্ধার হওয়া কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালেরা সমুদ্রপথে অবৈধভাবে পাচারের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। তাঁদের হোটেল ও বস্তি এলাকায় রাখা হয়। রাতে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাটে (বন্দরের জলসীমার আওতাভুক্ত) অপেক্ষমাণ মাছ ধরার ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তুলে দেওয়া হয়। যাত্রীদের ট্রলার বা নৌকার ভেতরে মাছ রাখার জায়গায় ও কেবিনে রাখা হয়। এরপর এসব যাত্রীকে গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ অন্য আরেকটি ট্রলারে তুলে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার স্পিডবোটে করে কর্ণফুলী থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ উপকূলে নিশ্ছিদ্র তদারকির ব্যবস্থা নেই। কোস্টগার্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, কুতুবদিয়া স্টেশনের কোনো স্পিডবোট নেই। বেশ কিছু স্টেশন থেকে কাঠের নৌকা দিয়ে তদারক করা হয়। রাতে মাছ ধরার ট্রলারে কর্ণফুলী নদী বা উপকূলীয় এলাকা থেকে মানব পাচার হলে তা শনাক্ত করা কঠিন বলে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কর্ণফুলী নদীর বন্দর জলসীমায় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় তিন হাজারবার জাহাজ ও জলযান আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে রয়েছে ছোট-বড় জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকা, ইঞ্জিনচালিত যাত্রীবাহী নৌকা। বন্দর সূত্র জানায়, বন্দরের নিরাপদ নৌ-চলাচল তদারকি পদ্ধতির মাধ্যমে এসব জাহাজ ও জলযানের গতিবিধি তদারকির সুযোগ থাকলেও ছোট নৌযান পুরোপুরি তদারক করা সম্ভব হয় না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানব পাচারের কৌশল নিয়েছে পাচারকারীরা। বন্দরের বোর্ড সদস্য কমোডর এম শাহজাহান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, নৌ-চলাচল তদারকির জন্য বন্দরের যে প্রযুক্তি রয়েছে এর মাধ্যমে কোন ট্রলারের ভেতর কী আছে, তা শনাক্ত করা যায় না। পাচারকারীরা যদি ট্রলারের ভেতরে মানব পাচার করে থাকে, সেটি সরাসরি তল্লাশি ছাড়া শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কোস্টগার্ডের একটি সূত্র জানায়, ২০১২ সালের দিকে চট্টগ্রাম উপকূল ব্যবহার করে মানব পাচারের চেষ্টা শুরু হয়। ওই বছর ৫ জুন কর্ণফুলী নদী দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ২৬ যাত্রী ও তিন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর ৭ জুলাই চারটি আবাসিক হোটেল থেকে দুই পাচারকারীসহ ৪৮ জন মালয়েশিয়াগামীকে আটক করে র্যাব। এ দুটি ঘটনার পর চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়নের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা থেকে ১১২ জন মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরের বছর ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর বহদ্দারহাটের খতিবের হাট এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে মালয়েশিয়াগামী ২৩ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে পাঁচলাইশ থানার পুলিশ। পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম উপকূল ব্যবহার করে মানব পাচারের চেষ্টার চারটি ঘটনায় দালালসহ ১৩৭ জনকে আটক করে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর মাঝিরঘাট এলাকায় মালয়েশিয়া পাচারকালে ৭০-৮০ জন যাত্রী নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ভোরে ডুবে যায় এফবি ইদ্রিস নামের একটি ট্রলার। এ ঘটনায় গতকাল দুপুর পর্যন্ত সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ৪৩ যাত্রী। তাঁদেরই একজন যশোরের ইয়াছিন হোসেন (১৮)। তিনি জানান, যশোরের এক দালালের মাধ্যমে তাঁরা ১১ জন চট্টগ্রামে আসেন। বুধবার তাঁদের শহরের একটি হোটেলে রাখা হয়। রাতে মাঝিরঘাট নেওয়া হয়। সেখানে আনুমানিক ২০০ জনের মতো ছিলেন। প্রথমে তাঁদের একটি বড় ট্রলারে ওঠানো হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর সাগরের মাঝখানে আরেকটি (এফবি ইদ্রিস) ট্রলারে অর্ধেক যাত্রী স্থানান্তর করা হয়। প্রথম ট্রলারটি কোথায় গেছে সেটি তাঁর জানা নেই।

No comments:

Post a Comment