Thursday, May 7, 2015

বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে ব্যাংক ঋণের দায়:যুগান্তর

আইপিওর (প্রাথমিক শেয়ার) মাধ্যমে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে কোম্পানিগুলো। ফলে কোম্পানির উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণের দায় শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের ওপর আসছে। ২০১১ সালে কমিশন পুনর্গঠনের পর এ পর্যন্ত ৫৫টি কোম্পানি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব কোম্পানি বাজার থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছে। যার ৭০ ভাগই ব্যাংক পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। এর ফলে বাজার থেকে টাকা নেয়ার পরও কোম্পানি সম্প্রসারণ হচ্ছে না। ফলে
আয়ও বাড়ছে না। যার কারণে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী হচ্ছেন পথের ভিখারি। বিনিয়োগকারীদের ওপর দায় চাপানোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ প্রিমিয়াম দেয়া হচ্ছে। তাদের মতে, পুরাতন খেলোয়াড়রাই বাজারে সক্রিয়। তাদের কারণেই বাজার তছনছ হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএসইসিকে সৎ ও সাহসী হতে হবে। তবে বিএসইসি বলছে, দায় চাপাতে নয়, কোম্পানিরগুলোর উৎপাদন বাড়াতেই আইপিও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তারাও স্বীকার করে, আইপিরও টাকায় ঋণ পরিশোধ বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে নিয়ম করে দেয়া হয়েছে, কোনো কোম্পানি এক- তৃতীয়াংশের বেশি টাকা ঋণ পরিশোধে ব্যয় করতে পারবে না। আর্থিক রিপোর্টের ক্ষেত্রে অডিটরদের ওপর নির্ভর করতে হয় তাদের। ব্যাংক ঋণ পরিশোধ : গত দুই বছরে যেসব কোম্পানি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধের অনুমতি পেয়েছে সেগুলো হল- হামিদ ফেব্রিকস, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস, সুরিদ ইন্ডাস্ট্রিজ, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, তুইং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং, পেনিন সুলা টিচাং, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফ্যামিলি টেক্সটাইল, অ্যাপোলো ইস্পাত, ওরিয়ন ফার্মা, বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মো প্লাস্টিক, গ্লোবাল হেভি কেমিক্যাল, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, জেনারেশন নেক্সট, আর্গন ডেনিম, সামিট পূর্বাঞ্চল পাওয়ার, আমরা টেকনোলজি, ইউনিক হোটেল, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল, ইউনাইটেড পাওয়ার, সজিব নিটওয়্যার ও তাসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ। সর্বশেষ আমান ফিড ইন্ডাস্ট্রিজকে আইপিওর টাকায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধের অনুমোদন দেয়া হয়। কমছে আয় : ২০১১ সালে বাজারে আসে আমরা টেকনোলজি। ওই বছর কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ২ টাকা ৬৩ পয়সা। কিন্তু ২০১২তে ২ টাকা ৪৬ পয়সায় নেমে আসে। আর্গন ডেনিমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ২০১১ সালের ৫ টাকা ৪৬ পয়সার ইপিএস ২০১২ সালে নেমে এসেছে ৪ টাকা ৫১ পয়সায়। বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মো প্লাস্টিকের ২০১১-১২ সালের ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এর ইপিএস দাঁড়ায় ২ টাকা ৩১ পয়সা। উচ্চ প্রিমিয়াম : মতিন স্পিনিং ১০ অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ারে ২৭ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে ১২৬ কোটি টাকা নেয়। এরমধ্যে শুধু প্রিমিয়াম ৯২ কোটি টাকা। পেনিনসুলা চিটাগাং ২০ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে ১৬৫ কোটি টাকা নেয়। এরমধ্যে ১১০ কোটি টাকাই প্রিমিয়াম। শাহজিবাজার পাওয়ার প্রতিটি শেয়ারে ১৫ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে ৩১ কোটি টাকা নেয়। এরমধ্যে ১৯ কোটি টাকা প্রিমিয়াম। ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িং ১০ টাকার শেয়ারে আরও ১৭ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে মোট ৬৭ কোটি টাকা নেয়। এর মধ্যে ৪২ কোটি প্রিমিয়াম। সাইফ পাওয়ার ২০ টাকা প্রিমিয়ামে ৩৬ কোটি টাকা নেয়। রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস ৩০ টাকা প্রিমিয়ামে ১০০ কোটি টাকা নেয়। এরমধ্যে ৭৫ কোটি প্রিমিয়াম। ওরিয়ন ফার্মার ২৪০ কোটির মধ্যে ২শ’ কোটি টাকা প্রিমিয়াম। এছাড়াও অ্যাপোলো ইস্পাতের ২২০ কোটি টাকার মধ্যে ১২০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম, ইউনাইটেড পাওয়ারকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ২৩৭ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২০৪ কোটি টাকা প্রিমিয়াম। সর্বশেষ আমান ফিড লিমিটেডকে ৭২ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৫২ কোটি টাকা প্রিমিয়াম। অর্থনীতিবিদদের অভিমত : জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে যারা খেলছে, তারা এত বেশি প্রভাবশালী যে, কোনো নিয়ম-কানুন মানছে না তারা। আর বিএসইসিও দুর্বল কোম্পানিকে অনুমোদন দিচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এসব কোম্পানি বাজারে সমস্যা তৈরি করবে। তার মতে, পুঁজিবাজার উন্নয়নের জন্য সরকারের সদিচ্ছা জরুরি। এরপর কারসাজি ঠেকাতে বিএসইসিকে সৎ ও সাহসী হতে হবে। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। কারণ ব্যাংক ঋণ পরিশোধের পর কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অবশ্যই ভালো হওয়ার কথা। তিনি বলেন, ঋণ শোধ হলে তার দায় কমে। এতে মুনাফা বাড়ে। কিন্তু আয় কমলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে তালিকাভুক্তির বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা উচিত। কারণ এসব কোম্পানি অতি মূল্যায়িত হয়ে তালিকাভুক্ত হলে বাজারে প্রভাব পড়ে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিনিয়োগকারীদেরও দেখেশুনে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি। ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, আইপিও অনুমোদন জরুরি। তবে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল ব্যাংক ঋণ পরিশোধে আইপিও না দিতে আমাদের পক্ষ থেকে বিএসইসির কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি তারা আমলে নেয়নি। তিনি বলেন, যেসব কোম্পানি ব্যাংক ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর শোধ করতে পারছে না সেগুলোই শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। বিএসইসির বক্তব্য : জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দায় বর্তায় এভাবে বলা যাবে না। কারণ ওই কোম্পানিগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ করে কোম্পানি সম্প্রসারণ করেছিল। ব্যাংকের সুদ অনেক বেশি। কিন্তু শেয়ারবাজারে আসার কারণে সুদের খরচ বেঁচে গেছে। ফলে এসব কোম্পানির উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে, এই বিবেচনা থেকে তাদের মূলধন সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়। আর বছর শেষে এসব কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দেবে- এমনটাই বিএসইসি চায়। তবে তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোর ঋণ পরিশোধের প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আর শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। গ্রস আয় কমার ব্যাপারে তিনি বলেন, বিএসইসি নিজে অডিট করে না। এক্ষেত্রে অডিটরদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে এখানে আমাদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। এরপরও কোম্পানির অনিয়ম ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।  

No comments:

Post a Comment